উন্নত দেশে প্রবাসী বাংলাদেশীদের জীবনের আলো-আঁধারির গল্প। চাকচিক্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নিঃসঙ্গতা, পেশাগত অবমূল্যায়ন ও মানসিক চাপ নিয়ে একটি গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ।
উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশী প্রবাসীদের জীবনযাত্রা ভাবলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে সুসংগঠিত সমাজ, আর্থিক সচ্ছলতা আর অপার সম্ভাবনার এক উজ্জ্বল চিত্র। ডলার বা ইউরোর ঝনঝনানি, পরিপাটি রাস্তাঘাট, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এবং সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি—এসব মিলিয়ে এক কথায় এক ঈর্ষণীয় জীবন। এই চিত্রটি মিথ্যা নয়, তবে এটি ছবির একটি খণ্ডিত অংশ মাত্র। এর আড়ালে লুকিয়ে আছে এমন সব গভীর, জটিল এবং অনেক ক্ষেত্রে আলোচনা-না-হওয়া কিছু বাস্তবতা, যা প্রবাসীর জীবনকে এক ‘সোনালি খাঁচা’র মতো করে তোলে। বাইরে থেকে যা কিছু সোনালি মনে হয়, তার ভেতরের নিঃসঙ্গতা, আত্মপরিচয়ের সংকট এবং মানসিক চাপের গল্পগুলো প্রায়শই আড়ালে থেকে যায়। এই প্রতিবেদনটি সেইসব সমস্যাগুলোকে গভীর থেকে বিশ্লেষণের একটি প্রচেষ্টা।
১. মানসিক বিচ্ছিন্নতা এবং ‘সফলতার মুখোশ’ পরে থাকার চাপ
প্রবাস জীবনের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে কম আলোচিত সমস্যা হলো একাকিত্ব এবং মানসিক বিচ্ছিন্নতা। উন্নত দেশগুলোর সমাজ ব্যবস্থা মূলত আত্মকেন্দ্রিক (individualistic)। এখানে বাংলাদেশের মতো পাড়া-প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনের সেই স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক বন্ধন নেই। কর্মব্যস্ত জীবনে সপ্তাহান্তে একটু দেখা-সাক্ষাৎ হলেও দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার মতো মানুষের অভাব প্রকট। এই নিঃসঙ্গতা ধীরে ধীরে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি বা মানসিক অবসাদ প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে একটি নীরব মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
এর সাথে যুক্ত হয় আরেক অদৃশ্য চাপ—‘সফলতার মুখোশ’ পরে থাকার বাধ্যবাধকতা। দেশে থাকা পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এবং সমাজের কাছে একজন প্রবাসী মানেই ‘সফল মানুষ’। এই ধারণা বা ইমেজ বজায় রাখার জন্য তাদের অবিরত লড়াই করে যেতে হয়। আর্থিক কষ্ট, কর্মক্ষেত্রের অপমান, মানসিক অশান্তি—কোনো কিছুই তারা সহজে প্রকাশ করতে পারেন না। কারণ, তাদের সামান্য ব্যর্থতার গল্প দেশে থাকা মানুষের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হতে পারে। এই দ্বৈত জীবন—বাইরে সফল এবং ভেতরে ক্ষতবিক্ষত—তাদের মানসিক শক্তিকে তিলে তিলে ক্ষয় করে দেয়। দেশে ফোন করে হাসিমুখে কথা বললেও, ফোন রাখার পর তাদের দীর্ঘশ্বাস ফেলার গল্পগুলো অজানাই থেকে যায়।
২. পেশাগত অবমূল্যায়ন এবং পরিচয়ের সংকট (Underemployment and Identity Crisis)
বহু প্রবাসী বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উন্নত দেশে পাড়ি জমান। কিন্তু ভাষার ভিন্নতা, সাংস্কৃতিক পার্থক্য এবং প্রাতিষ্ঠানিক সনদের непризнание (non-recognition) এর কারণে অনেকেই তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পান না। বাংলাদেশে যিনি ছিলেন একজন স্বনামধন্য প্রকৌশলী, ব্যাংকার বা শিক্ষক, তিনিই হয়তো প্রবাসে গিয়ে ট্যাক্সি চালান, সুপারস্টোরে কাজ করেন বা কোনো কারখানায় হাড়ভাঙা খাটুনি খাটেন। এই অবস্থাকে বলা হয় ‘আন্ডারএমপ্লয়মেন্ট’ বা পেশাগত অবমূল্যায়ন।
এই অবমূল্যায়ন শুধু আর্থিক ক্ষতি করে না, এটি একজন মানুষের আত্মসম্মান এবং আত্মপরিচয়কে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। “আমি কে?”—এই প্রশ্নটি তাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করে। দেশে যে সামাজিক মর্যাদা এবং সম্মান নিয়ে তারা অভ্যস্ত ছিলেন, প্রবাসে তার ছিটেফোঁটাও না থাকায় তারা এক গভীর পরিচয় সংকটে ভোগেন। তাদের অর্জিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা যখন কোনো কাজেই আসে না, তখন এক ধরনের শূন্যতা এবং হতাশা তাদের গ্রাস করে, যা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।
৩. প্রজন্মগত ব্যবধান এবং ‘থার্ড কালচার কিডস’ সমস্যা
প্রথম প্রজন্মের প্রবাসীরা যখন তাদের সন্তানদের উন্নত দেশে বড় করে তোলেন, তখন এক নতুন এবং জটিল সংকটের জন্ম হয়। তাদের সন্তানেরা, যারা ‘থার্ড কালচার কিডস’ (Third Culture Kids) নামে পরিচিত, তারা বাবা-মায়ের সংস্কৃতি এবং বেড়ে ওঠার দেশের সংস্কৃতির মাঝে এক দোলাচলে বড় হয়। তারা পুরোপুরি বাংলাদেশী নয়, আবার পুরোপুরি পশ্চিমাও নয়।
এই প্রজন্মগত সংঘাত পরিবারের ভেতরে নানা সমস্যার সৃষ্টি করে। বাবা-মায়েরা চান তাদের সন্তানেরা বাংলাদেশী সংস্কৃতি, ভাষা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে বড় হোক। অন্যদিকে, সন্তানেরা বেড়ে ওঠে পশ্চিমা শিক্ষা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং উদারনৈতিক সামাজিক পরিবেশে। ফলে ভাষা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে জীবনসঙ্গী নির্বাচন এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি বিষয়েই সংঘাত দেখা দেয়। অনেক পরিবারে বাবা-মা বাংলা বললেও সন্তানেরা স্বচ্ছন্দ বোধ করে ইংরেজি বা সেই দেশের ভাষায়, যা তাদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক দূরত্ব তৈরি করে। বাবা-মায়ের শেকড়ের টান আর সন্তানের উড়তে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা—এই দুইয়ের মাঝখানে পড়ে অনেক পরিবারেই অশান্তি নেমে আসে।
৪. রেমিট্যান্সের অদৃশ্য বোঝা এবং নতুন ধরনের অর্থনৈতিক দাসত্ব
প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। কিন্তু এই রেমিট্যান্স পাঠানোর পেছনে লুকিয়ে আছে এক ধরনের অদৃশ্য বোঝা এবং মানসিক চাপ। দেশে থাকা পরিবারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে অনেক প্রবাসী তাদের নিজেদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে বিসর্জন দেন। নিজের সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে, ওভারটাইম করে বা একাধিক কাজ করে তারা দেশে টাকা পাঠান।
উন্নত দেশগুলোর জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি। বাড়ি বা গাড়ির মর্টগেজ, ইন্স্যুরেন্স, সন্তানের শিক্ষার খরচ এবং অন্যান্য বিল পরিশোধ করার পর তাদের হাতে খুব সামান্যই অবশিষ্ট থাকে। অনেকেই ঋণের জালে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েন যে, তা থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এক নতুন ধরনের দাসত্ব তৈরি করে, যেখানে তারা একটি নির্দিষ্ট জীবনধারা বজায় রাখতে এবং দেশে টাকা পাঠাতে গিয়ে নিজেদের জীবনকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলতে বাধ্য হন। তাদের পাঠানো টাকায় দেশে হয়তো দালান ওঠে, কিন্তু বিদেশের মাটিতে তাদের জীবন কাটে অত্যন্ত হিসেব করে, অনেক ক্ষেত্রে মানবেতরভাবে।
৫. বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা এবং শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়
প্রবাস জীবনের শেষ অধ্যায়টি সম্ভবত সবচেয়ে করুণ। যৌবন এবং মধ্যবয়স কঠোর পরিশ্রমে পার করার পর যখন বার্ধক্য আসে, তখন প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি অসহায় বোধ করেন। উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবা উন্নত হলেও, সেখানে পারিবারিক ও সামাজিক সমর্থনের অভাব প্রকট। বাংলাদেশে বার্ধক্যে মানুষ যেমন পরিবার-পরিজন এবং নাতি-নাতনিদের সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ পায়, পাশ্চাত্যের সমাজে সেই সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। সন্তানেরা তাদের নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের ঠিকানা হয় ‘ওল্ড হোম’ বা নার্সিং হোমে।
এই সময়ে তাদের মধ্যে এক তীব্র শেকড়হীনতার ভয় কাজ করে। তারা ভাবেন, জীবনের শেষ দিনগুলো কোথায় কাটাবেন? নিজের দেশে ফিরবেন, নাকি যে মাটিতে জীবনের সোনালি সময়টা কাটিয়ে দিলেন সেখানেই থাকবেন? মৃত্যুর পর তাদের দাফন বা সৎকার কোথায় হবে—জন্মভূমিতে নাকি প্রবাসের মাটিতে? এই প্রশ্নগুলো তাদের মানসিকভাবে অত্যন্ত পীড়া দেয়। যে মাটির টানে তারা সারাজীবন দেশে টাকা পাঠালেন, সেই মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আকাঙ্ক্ষা অনেক প্রবাসীর কাছেই এক অপূর্ণ স্বপ্ন হয়ে থেকে যায়।
উন্নত দেশে বাংলাদেশী প্রবাসীদের জীবন নিঃসন্দেহে অনেক সুযোগ এবং সম্ভাবনা তৈরি করে, কিন্তু তার পেছনের গল্পগুলো প্রায়শই জটিল এবং বেদনাদায়ক। আর্থিক স্বচ্ছলতার বিনিময়ে তাদের যে মানসিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মূল্য দিতে হয়, তার পরিমাপ করা কঠিন। এই প্রতিবেদনটির উদ্দেশ্য প্রবাস জীবনকে হেয় করা নয়, বরং একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং বাস্তবসম্মত চিত্র তুলে ধরা। সোনালি খাঁচার পাখিরাও যে উড়তে ভুলে যায় এবং তাদেরও যে কষ্ট আছে, সেই সত্যটি আমাদের বোঝা প্রয়োজন। প্রবাসীদের সাফল্য কেবল তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের অংকে পরিমাপ না করে, তাদের মানসিক সুস্থতা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং আত্মমর্যাদা দিয়েও বিচার করা উচিত। তবেই আমরা তাদের ত্যাগের এবং সংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করতে পারব।
📌 প্রশ্নোত্তর (FAQ):
প্রশ্ন ১: প্রবাসে বাংলাদেশীরা সবচেয়ে বড় কোন সমস্যার মুখোমুখি হন?
উত্তর: সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মানসিক নিঃসঙ্গতা এবং সমাজে বিচ্ছিন্নতা। উন্নত দেশের ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় তারা মানসিক অবসাদে ভোগেন।
প্রশ্ন ২: উন্নত দেশে পেশাগত অবমূল্যায়ন কেন হয়?
উত্তর: ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা, শিক্ষাগত ডিগ্রির স্বীকৃতি না পাওয়া এবং সাংস্কৃতিক ব্যবধানের কারণে অনেক প্রবাসী যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পান না।
প্রশ্ন ৩: থার্ড কালচার কিডস বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: এরা এমন শিশু যারা বাবা-মায়ের একটি সংস্কৃতিতে জন্ম নিলেও বড় হয় ভিন্ন দেশের পরিবেশে, ফলে তারা দুটি সংস্কৃতির মাঝে দ্বন্দ্বে পড়ে।
প্রশ্ন ৪: প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠাতে গিয়ে কী ধরনের চাপ অনুভব করেন?
উত্তর: পরিবারের চাহিদা পূরণে নিজের প্রয়োজন বিসর্জন দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়, ফলে মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা।
প্রশ্ন ৫: বার্ধক্যে প্রবাসীরা কী সমস্যায় পড়েন?
উত্তর: বার্ধক্যে অনেক প্রবাসী নিঃসঙ্গতা ও শিকড় হারানোর বেদনায় ভোগেন। সন্তানদের ব্যস্ততায় অনেকের ঠিকানা হয় নার্সিং হোম বা বৃদ্ধাশ্রম।
❤️ লেখাটি ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করুন—আপনার শেয়ার হয়তো কাউকে বাস্তবতা বুঝতে বা মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করতে পারে।
✍️ আপনার মন্তব্য লিখুন:
আপনার নাম ও মতামত দিন। গঠনমূলক আলোচনা আমরা স্বাগত জানাই।