বাংলাদেশে নারীদের স্বপ্নপূরণের পথে অন্যতম বড় বাধা হলো পথেঘাটে অহরহ ঘটে যাওয়া ইভটিজিং ও সামাজিক হয়রানি। শুধু ভয়ের কারণে অনেক নারী শিক্ষা, কর্মসংস্থান কিংবা স্বপ্নের লক্ষ্যে এগোতে পারে না। পিতামাতার আশঙ্কা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা এবং নির্যাতনের ভয় তাদের আটকে রাখে ঘরের চার দেয়ালে।
এটি শুধু নারীর ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং পুরো সমাজের অগ্রগতিকে বাঁধাগ্রস্ত করে।
সমাজের মানসিকতা পরিবর্তন, সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ ছাড়া এই নির্মম বাস্তবতা থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই।
এটাই বাংলাদেশের নারীর স্বপ্নভঙ্গের নিষ্ঠুর সত্য।
বাংলাদেশ, ইভটিজিং, নারীর স্বপ্ন, সামাজিক নিরাপত্তা, পথের ভয়, নারীর অধিকার, হয়রানি, নারী নির্যাতন, স্বপ্নভঙ্গ,
রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির ছুড়ে দেওয়া শিস কিংবা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় কানে আসা অশ্লীল মন্তব্যটি কেবল একটি শব্দ বা মুহূর্তের অস্বস্তি নয়। এটি একটি মেয়ের বুকের গভীরে গেঁথে যাওয়া অদৃশ্য ছুরি। এটি তার ডানার পালক একটি একটি করে খসিয়ে নেওয়ার নির্মম আয়োজন। প্রতিদিন খবরের কাগজের কোণায়, টেলিভিশন স্ক্রলে বা সামাজিক মাধ্যমের টাইমলাইনে "ইভটিজিং" শব্দটি ভেসে ওঠে, কিন্তু এর আড়ালে চাপা পড়ে যায় হাজারো স্বপ্নের অপমৃত্যুর করুণ কাহিনী।
ইভটিজিং কোনো সাধারণ উৎপাত নয়। এটি একটি সামাজিক ক্যান্সার, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নারীর অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এটি একটি মেয়ের আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রথম ধাপ, তার শিক্ষাজীবনে দাঁড়ি টেনে দেওয়ার ষড়যন্ত্র এবং তার স্বাধীন সত্তাকে খাঁচায় বন্দি করার এক নীরব প্রক্রিয়া।
এই লেখায় আমরা শুধু সমস্যার উপরিভাগে বিচরণ করব না। আমরা ডুব দেব সেই গভীর ক্ষতে, যেখানে একটি মেয়ের ডাক্তার, শিল্পী বা বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন এই সামাজিক ব্যাধির কাছে করুণভাবে পরাজিত হয়। আমরা কেবল অপরাধীকে নয়, এর পেছনের মনস্তত্ত্ব এবং আমাদের সম্মিলিত উদাসীনতাকেও ব্যবচ্ছেদ করব।
এক যে ছিল অনিকা: একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু
ধরা যাক অনিকার গল্প। মফস্বলের ছোট্ট একটি মেয়ে, যার চোখে ছিল আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বসা অনিকার গণিতের খাতায় ছিল নির্ভুল সমাধান, আর মনের ক্যানভাসে ছিল একজন স্থপতি হওয়ার রঙিন নকশা। তার বাবা-মা শত কষ্টের মাঝেও স্বপ্ন দেখতেন, তাদের মেয়ে একদিন অনেক বড় হবে।
কলেজে যাওয়ার পথটা ছিল তার সবচেয়ে আনন্দের। কিন্তু সেই আনন্দ ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করল। প্রতিদিন রাস্তার মোড়ের কিছু বখাটে ছেলের দল তাকে উদ্দেশ্য করে বাজে মন্তব্য করত। প্রথমে সে এড়িয়ে যেত, কানে তুলত না। কিন্তু দিন দিন তাদের স্পর্ধা বাড়তে লাগল। পিছু নেওয়া, চলার পথ আটকে ধরা, এমনকি তার ওড়না ধরে টান দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটল।
অনিকা ভয় পেয়ে গেল। তার পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসতে লাগল। যে পথ দিয়ে সে হাসিমুখে কলেজে যেত, সেই পথ তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হতে লাগল। পড়াশোনায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলল, রাতের ঘুম কেড়ে নিল অজানা আতঙ্ক। সে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করল। তার প্রাণোচ্ছল হাসির জায়গায় স্থান নিল একরাশ নীরব বিষণ্ণতা।
পরিবারকে জানালে তারা মেয়ের "নিরাপত্তা" আর "সম্মান" নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। সমাধানের পথ হিসেবে তারা বেছে নিল সবচেয়ে সহজ কিন্তু সবচেয়ে বিধ্বংসী উপায়টি—অনিকার পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হলো। যে মেয়েটির হাতে থাকার কথা ছিল স্কেল আর কম্পাস, তার হাতে তুলে দেওয়া হলো সংসারের দায়িত্ব। স্থপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখা অনিকার পৃথিবী সীমাবদ্ধ হয়ে গেল রান্নাঘরের চার দেয়ালে। এটি শুধু অনিকার গল্প নয়, এটি বাংলাদেশের হাজারো অনিকার অলিখিত ট্র্যাজেডি।
যেভাবে স্বপ্নের প্রাসাদ ভেঙে পড়ে: মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক প্রভাব
ইভটিজিংয়ের প্রভাব কেবল তাৎক্ষণিক নয়, এটি সুদূরপ্রসারী এবং বহুমাত্রিক।
১. মানসিক স্বাস্থ্যের মৃত্যু: এটি একটি মেয়ের আত্মাকে ধীরে ধীরে হত্যা করে।
আত্মবিশ্বাসের সংকট: সে নিজেকেই দোষারোপ করতে শুরু করে। "আমার পোশাকে কি সমস্যা?", "আমি কেন সন্ধ্যায় বাইরে গেলাম?"—এই প্রশ্নগুলো তার আত্মমর্যাদাকে কুরে কুরে খায়।
বিষণ্ণতা ও উদ্বেগ (Anxiety): প্রতিটি মুহূর্ত কাটে এক অজানা ভয়ে। সে জনসমাগম এড়িয়ে চলে, নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এই দীর্ঘমেয়াদী উদ্বেগ তাকে ঠেলে দেয় ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের দিকে।
পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD): গুরুতর ক্ষেত্রে, ভুক্তভোগীরা PTSD-তে আক্রান্ত হয়। একটি সাধারণ শিসের শব্দ বা কোনো পুরুষের চাহনিও তার মধ্যে তীব্র আতঙ্ক (Panic Attack) তৈরি করতে পারে।
২. শিক্ষার আলো নিভে যাওয়া: ইভটিজিং সরাসরি নারীর শিক্ষার অধিকারকে কেড়ে নেয়। পরিবারগুলো প্রায়শই "সম্মানহানি"র ভয়ে মেয়েদের স্কুল-কলেজ ছাড়িয়ে দেয়। ফলে একটি সম্ভাবনাময় প্রজন্ম উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, যা দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা।
৩. বাল্যবিবাহের অভিশাপ: যখন সমাজ ও রাষ্ট্র একটি মেয়েকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তখন পরিবার তাকে "নিরাপদ" করার জন্য বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেয়। এই বাল্যবিবাহ তার শৈশব, স্বপ্ন এবং সম্ভাবনাকে চিরতরে কবর দিয়ে দেয়।
৪. অর্থনৈতিক পরাধীনতা: শিক্ষা সম্পূর্ণ না হওয়ায় নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এটি কেবল তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার হানি ঘটায় না, পরিবার ও সমাজের উপরও নির্ভরশীলতার বোঝা বাড়ায়।
কেন থামছে না এই ব্যাধি? অপরাধী এবং সমাজের মনস্তত্ত্ব ঃ
এর কারণগুলো আমাদের সমাজের গভীরে প্রোথিত।
পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার আস্ফালন: অনেক পুরুষের কাছে নারীকে উত্ত্যক্ত করা পৌরুষ প্রদর্শনের একটি মাধ্যম। নারীর "না"-কে অগ্রাহ্য করার মধ্যে তারা এক ধরনের বিকৃত আনন্দ খুঁজে পায়। এটি নারীকে বস্তু হিসেবে দেখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি: অপরাধীরা জানে, তাদের কিছুই হবে না। প্রভাবশালী মহলের চাপ, সামাজিক লজ্জা এবং আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অধিকাংশ ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়। এই বিচারহীনতা নতুন অপরাধীদের জন্ম দেয়।
দর্শকের ভূমিকা (Bystander Effect): রাস্তায় একটি মেয়েকে হেনস্তা হতে দেখেও আমরা অধিকাংশ মানুষ নীরব থাকি। ভাবি, "অন্য কেউ প্রতিবাদ করবে" অথবা "ঝামেলায় জড়িয়ে কী লাভ?"। আমাদের এই সম্মিলিত নীরবতাই অপরাধীদের সবচেয়ে বড় শক্তি।
বিকৃত মানসিকতার লালন: পরিবার ও সমাজে নৈতিক শিক্ষার অভাব, সুস্থ সংস্কৃতির অনুপস্থিতি এবং নারীকে সম্মান করার মানসিকতা তৈরি না হওয়ায় এক ধরনের বিকৃত মানসিকতার প্রজন্ম বেড়ে উঠছে।
উত্তরণের পথ: যেখানে প্রতিরোধই শ্রেষ্ঠ প্রতিকার ঃ
এই অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরতে হলে আমাদের একটি সামগ্রিক এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পরিবার থেকে শুরু: ছেলে সন্তানকে শেখাতে হবে নারীর সম্মতি (Consent) কী এবং কেন তা জরুরি। তাকে শেখাতে হবে, সত্যিকারের পৌরুষ নারীকে সম্মান করায়, অসম্মান করায় নয়। মেয়ে সন্তানকে শেখাতে হবে প্রতিবাদী হতে এবং তার পাশে থাকার আশ্বাস দিতে হবে।
সামাজিক জাগরণ: পাড়া-মহল্লায় প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলতে হবে। কোনো ঘটনা দেখলে এড়িয়ে না গিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করতে হবে। bystander থেকে upstander হতে হবে।
আইনের কঠোর প্রয়োগ: আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অপরাধীরা ভয় পায়। পুলিশ এবং বিচার ব্যবস্থাকে আরও সংবেদনশীল হতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা: ভুক্তভোগীদের জন্য স্কুল, কলেজ এবং কমিউনিটি পর্যায়ে বিনামূল্যে কাউন্সেলিং এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
শেষ কথা: এই দায় আমাদের সবার
ইভটিজিংয়ের কাছে একটি মেয়ের স্বপ্নের পরাজয় কেবল তার একার পরাজয় নয়। এটি তার পরিবারের, আমাদের সমাজের এবং আমাদের রাষ্ট্রের সম্মিলিত পরাজয়। যে দেশে নারীরা দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন, সে দেশে রাস্তায় চলতে গিয়ে একটি সাধারণ মেয়ের স্বপ্ন কেন ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে?
প্রতিটি মেয়ের অধিকার আছে ভয়হীনভাবে স্বপ্ন দেখার এবং সেই স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাওয়ার। আসুন, আমরা এমন একটি সমাজ গড়ি যেখানে কোনো অনিকার স্বপ্নকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতে হবে না। এই দায় আমাদের সবার। প্রতিরোধের প্রথম পাথরটি আপনাকেই স্থাপন করতে হবে—আজ, এখনই।
📝 পাঠকদের উদ্দেশ্যে অনুরোধ:
প্রিয় পাঠক,
সমাজে নারীদের স্বপ্ন যেন আর পথের ভয়য়ে থেমে না যায় — এই ভাবনা থেকেই এই লেখা।
আপনি যদি মনে করেন এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, দয়া করে আপনার বন্ধু, পরিবার এবং সমাজে শেয়ার করুন।
আপনার সচেতনতা, একটি শেয়ার, একটি মন্তব্য — কোনো না কোনো নারীর স্বপ্নের পথে সাহস হয়ে দাঁড়াতে পারে।
মতামত ও অভিজ্ঞতা কমেন্টে জানালে আনন্দিত হবো।
চলুন, সবাই মিলে পরিবর্তনের পথে হাঁটি।
👉 শেয়ার করুন, পরিবর্তনে অংশ নিন
👉 সচেতন হোন, সচেতন করুন
👉 আপনার মতামত দিন
👉 সমাজ বদলান, ভয় দূর করুন
👉 প্রতিবাদ করুন, পাশে থাকুন
👉 পড়ুন ও শেয়ার করুন
👉 আওয়াজ তুলুন নারীর অধিকারে
👉 এখনই শেয়ার করুন
👉 সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিন
👉 এই লেখা শেয়ার করুন — আপনার শেয়ারই পারে সাহস দিতে
🔗 শেয়ার করতে ভুলবেন না!
💬 আপনার মূল্যবান মন্তব্য আমাদের অনুপ্রেরণা।
Tags
Social Insights