বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় বৈষম্য ও ন্যায়বিচারের সংকট

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় বৈষম্য ও ন্যায়বিচারের সংকট

ন্যায়বিচারের স্বপ্ন ও কঠিন বাস্তবতা

ন্যায়বিচার একটি মৌলিক মানবাধিকার এবং সুশাসনের ভিত্তি। এটি প্রত্যাশা করে যে, আইনের চোখে সবাই সমান হবে এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে প্রত্যেকেই সমানভাবে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী হবে। এই নীতি একটি সভ্য সমাজের অপরিহার্য স্তম্ভ। দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশে এই স্বপ্ন প্রায়শই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। আইন ও বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান বৈষম্য, বিশেষ করে ধনী ও গরিবের মধ্যে, একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়।


ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের (WJP) অনুমান অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫ বিলিয়ন মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত, যা বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। এর মধ্যে ১.৫ বিলিয়ন মানুষ দৈনন্দিন আইনি সমস্যার সমাধান পান না এবং ৪.৫ বিলিয়ন মানুষ আইনি সুযোগ থেকে বঞ্চিত, যেমন পরিচয়পত্র বা জমির দলিল। এই "ন্যায়বিচার ব্যবধান" (Justice Gap) মানব উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে এবং দারিদ্র্যকে আরও শক্তিশালী করে, যার ফলস্বরূপ উচ্চ সামাজিক ব্যয় হয় । এই পরিসংখ্যানগুলি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরে: ন্যায়বিচারের অভাব বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি বিশ্বব্যাপী আইনি ব্যবস্থার একটি মৌলিক, পদ্ধতিগত ব্যর্থতা, যা বিশ্বের বিশাল জনগোষ্ঠীকে সেবা দিতে ব্যর্থ। এর অর্থ হলো, বাংলাদেশের সমস্যাগুলি একটি বৃহত্তর বৈশ্বিক পদ্ধতিগত সমস্যার অংশ, এবং সমাধান কেবল ব্যক্তিগত দুর্নীতি বা পক্ষপাতিত্বের মোকাবিলা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং মৌলিক কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে আইনকে সকলের জন্য সহজলভ্য ও ক্ষমতায়নকারী করে তোলার ওপরও নির্ভর করে। বাংলাদেশেও এই বৈষম্যের চিত্র ভিন্ন নয়, যেখানে ন্যায়বিচারের সার্বজনীন ধারণা প্রায়শই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এই ব্লগ পোস্টের উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান বৈষম্যের গভীর বিশ্লেষণ করা, এর কারণ ও পরিণতি তুলে ধরা এবং এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তৈরি করা।

আইন ধনীর জন্য নমনীয়, গরিবের জন্য কঠোর: অর্থের কাছে আইনের নতি স্বীকার

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় ধনী এবং গরিবের প্রতি আইনের প্রয়োগে স্পষ্ট বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান ও হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম অকপটে স্বীকার করেছেন যে, "আইন ধনীদের জন্য বেশি এগিয়ে চলে।" এর মূল কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, "ধনীদের অর্থ আছে। তারা ভালো আইনজীবী রাখতে পারেন। আইনজীবীর পেছনে ভালো অর্থ খরচ করতে পারেন। যার কারণে আইন ধনীদের দিকে বেশি ধাবিত হয়। এটাই বাস্তব।" এর বিপরীতে, "গরিবের অর্থ নেই। ফলে আইন তাদের পক্ষে অনেক সময় থাকে না। কারণ তারা ভালো আইনজীবী রাখতে পারেন না। ফলে তারা ভালো আইন উপস্থাপন করতে পারেন না" । এই বক্তব্য বিচার ব্যবস্থার অভ্যন্তর থেকে আসা একটি শক্তিশালী স্বীকৃতি, যা আইনের প্রয়োগে বিদ্যমান আর্থিক বৈষম্যকে স্পষ্ট করে।

অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং অপরাধের মধ্যে একটি জটিল ও বহুমাত্রিক সম্পর্ক বিদ্যমান। অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী, ব্যক্তি তখনই অপরাধমূলক আচরণে জড়িয়ে পড়ে যখন তারা মনে করে যে, এর সম্ভাব্য সুবিধা শাস্তির খরচের চেয়ে বেশি। গ্যারি বেকার-এর এই তত্ত্ব অনুসারে, সীমিত অর্থনৈতিক সুযোগের কারণে সুবিধাবঞ্চিত পটভূমির ব্যক্তিরা অবৈধ কার্যকলাপ থেকে উচ্চতর সুবিধা উপলব্ধি করতে পারে, যা তাদের অপরাধে জড়ানোর সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় । অর্থাৎ, দারিদ্র্য কেবল একটি পটভূমি নয়, বরং এটি অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িত হওয়ার একটি সরাসরি চালিকাশক্তি, যা দরিদ্রদের বিচার ব্যবস্থার সাথে বেশি মিথস্ক্রিয়া ঘটাতে পারে। বিশ্বব্যাপী দেখা যায়, অর্থনৈতিক বৈষম্য যত বেশি, অপরাধের হারও তত বেশি। উদাহরণস্বরূপ, উচ্চ গিনি সহগযুক্ত দেশগুলিতে (যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা ০.৬৩, ব্রাজিল ০.৫৪) হত্যার হারও তুলনামূলকভাবে বেশি (যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা ৩৪.৬, ব্রাজিল ২৭.৫) । এই বৈশ্বিক প্রবণতা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রযোজ্য, যেখানে উচ্চ অর্থনৈতিক বৈষম্য বিচার ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করে।

বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতি একটি গভীর সমস্যা, যা আইনের এই নমনীয়তাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (TIB) ২০২১ সালের জরিপ অনুযায়ী, বিচারিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের ৫৬.৮ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন । এই দুর্নীতি ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করে, সামাজিক বৈষম্যকে আরও গভীর করে এবং জন আস্থাকে ক্ষুণ্ণ করে । ভূমি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ১.৩ মিলিয়ন হেক্টর সরকারি জমি প্রভাবশালী অভিজাতদের দখলে রয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ ও কাগজ-ভিত্তিক ভূমি নিবন্ধন ব্যবস্থা দুর্নীতি ও জালিয়াতিকে সহজ করে, যার ফলে গরিব ভূমি মালিকরা প্রায়শই তাদের অজান্তেই সম্পত্তি বিক্রি হয়ে যাওয়ার ঘটনায় বছরের পর বছর মামলায় জড়িয়ে পড়েন এবং জমি পুনরুদ্ধারে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হন, যা শেষ পর্যন্ত তাদের ভূমিহীন করে তোলে । এই পরিস্থিতি দেখায় যে, বিচার ব্যবস্থার অদক্ষতা এবং দুর্নীতির প্রতি সংবেদনশীলতা কীভাবে দরিদ্রদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে তাদের আরও প্রান্তিক করে তোলে।

উচ্চ-মূল্যের মামলা বা রাজনীতিবিদ/ব্যবসায়ীদের জড়িত মামলাগুলিতে 'অনুকূল রায়'-এর বিনিময়ে 'মোটা অঙ্কের অর্থ বা অন্যান্য সুবিধা'র প্রস্তাব দেওয়া হয়, যা দ্রুত অর্থ উপার্জনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। সামাজিক সম্পর্ক, যেমন একই স্কুল, সমিতি বা আত্মীয়তার সম্পর্ক, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জন্য বিচারিক প্রক্রিয়ায় সরাসরি যোগাযোগ সহজ করে । এটি কেবল ভালো আইনজীবী নিয়োগের বিষয় নয়, বরং অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্ক এবং ঘুষের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াকে বাইপাস করার বিষয়, যা ধনী ও ক্ষমতাশালীদের সরাসরি সুবিধা দেয়। এই পরিস্থিতি ইঙ্গিত করে যে, আইনের "নমনীয়তা" কেবল একটি নিষ্ক্রিয় পক্ষপাত নয়, বরং আর্থিক এবং সামাজিক প্রভাবের একটি সক্রিয় পরিণতি, যেখানে যোগ্যতা এবং আইন গৌণ হয়ে পড়ে সংযোগ এবং অর্থের কাছে। এর ফলে, আইন তার নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলে এবং একটি "প্রভাব অর্থনীতি" তৈরি হয়, যেখানে ন্যায়বিচার কেনাবেচা হয়।

আইনি সহায়তায় বৈষম্য: দুর্বল আইনি সহায়তা ও তার প্রভাব

ধনী ব্যক্তিরা সহজেই সুপরিচিত এবং অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন, যারা তাদের পক্ষে শক্তিশালী আইনি যুক্তি এবং নজির উপস্থাপন করতে সক্ষম। এর বিপরীতে, গরিব বিচারপ্রার্থীরা অর্থের অভাবে মানসম্পন্ন আইনজীবী পেতে পারেন না, ফলে তাদের আইনি অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে । এই বৈষম্য ন্যায়বিচারের মৌলিক ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

অসহায়, দুস্থ ও গরিব বিচারপ্রার্থীদের আইনি সেবা প্রদানের জন্য ২০০০ সালে সরকার লিগ্যাল এইড প্রতিষ্ঠা করে । সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ আইনের চোখে সকলের সমতার নিশ্চয়তা দেয় এবং ৩৩ অনুচ্ছেদ ন্যায্য বিচারের অধিকার নিশ্চিত করে, যা জাতীয় আইনি সহায়তা ব্যবস্থার ভিত্তি । লিগ্যাল এইড ব্যবস্থা আইনগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতার বৈষম্য হ্রাস করে এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবধান দূর করতে সহায়তা করে ।

তবে, লিগ্যাল এইড আইন প্রণয়নের ২২ বছর পরও দেশের মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে গ্রামের মানুষের মধ্যে লিগ্যাল এইড সম্পর্কে ধারণা কম । এর কার্যকারিতা বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন:

কঠোর যোগ্যতা মানদণ্ড: আইনি সহায়তার জন্য বার্ষিক আয় ১,০০,০০০ টাকা (সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রে ১,৫০,০০০ টাকা) এর নিচে হতে হবে, যা অনেক সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তির বাস্তব আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে না ।

অপর্যাপ্ত বাজেট ও প্রশাসনিক ব্যয়: ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আইনি সহায়তার বাজেট ৫৭.৭ মিলিয়ন টাকা হলেও এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রশাসনিক ব্যয়ে খরচ হয়, ফলে সরাসরি আইনি সহায়তার জন্য সীমিত সংস্থান থাকে ।

সীমিত পরিধি: 
আইনি সহায়তার তহবিল শুধুমাত্র আদালতের ফি এবং আইনজীবীর পারিশ্রমিক কভার করে। বিশেষজ্ঞের মতামত, সাক্ষীর ফি এবং যাতায়াত খরচের মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনার খরচগুলো এর আওতার বাইরে থাকে । এই সীমাবদ্ধতাগুলি "বিনামূল্যে" আইনি সহায়তার ধারণাকে কার্যত দুর্বল করে তোলে, কারণ দরিদ্র ব্যক্তিরা এই "লুকানো খরচ" বহন করতে অক্ষম হন।

নিম্নমানের পারিশ্রমিক ও আইনজীবীদের অনীহা: প্যানেল আইনজীবীদের অপর্যাপ্ত পারিশ্রমিকের কারণে অনেক অভিজ্ঞ আইনজীবী লিগ্যাল এইড মামলা থেকে দূরে থাকেন, ফলে কম দক্ষ আইনজীবীরা এসব মামলা পরিচালনা করেন, যা সেবার মানকে প্রভাবিত করে । কিছু লিগ্যাল এইড আইনজীবী ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি দাবি করেন, যা বিনামূল্যে আইনি সহায়তার মূলনীতি লঙ্ঘন করে । এই পরিস্থিতি আইনি সহায়তার মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে এবং জন আস্থাকে ক্ষুণ্ণ করে।

এই ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরে: আইনগত সহায়তা কাগজে-কলমে "বিনামূল্যে" হলেও, এর সীমিত পরিধি এবং প্যানেল আইনজীবীদের দ্বারা "অতিরিক্ত ফি" চাওয়ার অভিযোগ দরিদ্রদের জন্য উল্লেখযোগ্য "লুকানো খরচ" তৈরি করে। এর ফলে, আইনি সহায়তার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়, এমনকি যারা যোগ্য, তাদের জন্যও এটি অকার্যকর বা অসাধ্য হয়ে পড়ে, যা ন্যায়বিচারে আর্থিক বাধা বজায় রাখে।

ব্লাস্ট (BLAST) এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র (ASK)-এর মতো বেসরকারি সংস্থাগুলো বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী বা বৈষম্যের শিকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা তথ্য, পরামর্শ, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR) এবং বিনামূল্যে আইনি প্রতিনিধিত্ব প্রদান করে । সুপ্রিম কোর্ট 'লোকাস স্ট্যান্ডি' (locus standi) নিয়মকে প্রসারিত করে জনস্বার্থ মামলা (PIL) দায়েরের সুযোগ করে দিয়েছে, যা এনজিও এবং আইনজীবীদের জন্য সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তিদের পক্ষে কাজ করার পথ খুলে দিয়েছে । তবে, তাদের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, এই সংস্থাগুলির সংস্থান সীমিত এবং তাদের প্রভাব নির্দিষ্ট ক্ষেত্র বা মামলার প্রকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে । এনজিওগুলির এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, একই সাথে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ব্যর্থতাকেই তুলে ধরে, যা ইঙ্গিত করে যে মৌলিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি অপরিহার্য।

ব্যক্তিগত আইনজীবীর উচ্চ ফি এবং সরকারি আইনি সহায়তার সীমাবদ্ধতার মধ্যে বিদ্যমান আর্থিক বৈষম্য সুস্পষ্ট। ব্যক্তিগত আইনজীবীর ক্ষেত্রে সাধারণ পরামর্শের জন্য প্রতি ঘন্টায় ২০০০-৫০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে । নিম্ন আদালতে প্রতিদিন হাজিরা দিতে ১০০০ টাকা এবং প্রতি শুনানিতে ২৫০০ টাকা লাগতে পারে । হাইকোর্টে রিট বা আপিল ড্রাফটিংয়ের জন্য ২০,০০০-৩৫,০০০ টাকা এবং প্রতি শুনানিতে ১০,০০০-১৫,০০০ টাকা খরচ হতে পারে । আপিল বিভাগে লিভ টু আপিলের শুনানির জন্য ৪০,০০০-৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত ফি লাগতে পারে । এছাড়াও, ভূমি ভেটিং বা দলিলের কাজের মতো অন্যান্য খরচও ২৫০০-৯৫০০ টাকা বা তার বেশি হতে পারে । এর বিপরীতে, সরকারি আইনি সহায়তা বিনামূল্যে হলেও, এটি বিশেষজ্ঞের মতামত, সাক্ষীর ফি এবং যাতায়াত খরচের মতো গুরুত্বপূর্ণ খরচগুলি কভার করে না । এমনকি, কিছু লিগ্যাল এইড আইনজীবীর বিরুদ্ধে ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি চাওয়ার অভিযোগও রয়েছে । এই চিত্রটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে, ব্যক্তিগত আইনজীবীর মাধ্যমে আইনি সেবা গ্রহণ করা কতটা ব্যয়বহুল, যা দরিদ্রদের জন্য প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে, সরকারি আইনি সহায়তা বিনামূল্যে হলেও, এর সীমিত পরিধি এবং "লুকানো খরচ" দরিদ্রদের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়, যা তাদের জন্য ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে কঠিন করে তোলে।

রাজনৈতিক মামলায় পক্ষপাতদুষ্ট বিচার: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ

বাংলাদেশের বিচার বিভাগ রাজনৈতিক ইস্যুতে রায় দিয়েছে, বিশেষ করে সাংবিধানিক সংশোধনী মামলায়। তবে, প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল - আওয়ামী লীগ (AL) এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (BNP)-এর মধ্যে গভীর শত্রুতা ও আস্থার অভাবের কারণে বিচার বিভাগ 'সম্পূর্ণরূপে রাজনীতিকৃত' হয়েছে । বিচারকের নিয়োগে (হাইকোর্ট বিভাগ থেকে আপিল বিভাগে পদোন্নতি এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগে) রাজনৈতিক প্রভাবের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে । সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, বিশেষ করে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বর্তমান সরকার আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠায়, বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণ (এবং সম্ভবত পরাধীনতা) একটি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করছে বলে মনে হয় । এর অর্থ হলো, বিচারকদের স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক ক্ষমতা বিচারিক স্বাধীনতাকে অতিক্রম করতে পারে, যা বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতাকে গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

বিচার ব্যবস্থা 'রাজনৈতিক প্রতিশোধের মঞ্চে' পরিণত হয়েছে। আদালতকক্ষগুলো প্রায়শই 'রাজনৈতিক গুণ্ডা ও ধর্মীয় উন্মাদদের' দ্বারা প্রভাবিত হয়, যারা বিচারক ও আইনজীবীদের হুমকি দেয় এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করে। যদি কারো রাজনীতি ক্ষমতাসীনদের সাথে না মেলে, তবে তারা ন্যায্য শুনানি বা জামিন পান না, এমনকি আদালতকক্ষে প্রবেশও তাদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে । 'ভুয়া মামলা' রাজনৈতিক যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে 'জাল এফআইআর এবং ভূতুড়ে সাক্ষী' ব্যবহার করা হয় ভিন্নমত দমন করতে । ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (DSA), যা বর্তমানে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে পরিচিত, সমালোচকদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এই আইনের অধীনে ১,৪৩৬টি মামলায় ৪,৫২০ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে । এই প্রবণতাগুলি সংবিধান দ্বারা নিশ্চিতকৃত মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বিচার বিভাগ কতটা সমুন্নত রাখছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

আদালত প্রাঙ্গণে জনতা বা রাজনৈতিক কর্মীদের দ্বারা বিচারক ও আইনজীবীদের ভয় দেখানো এবং হয়রানির ঘটনা ঘটেছে । জামিনের শুনানি রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। আইনজীবীরা তাদের নিরাপত্তার জন্য ভীত, প্রতিরক্ষা দলগুলিকে আদালতকক্ষে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। বিচারকদের সতর্ক করা হয়, জোর করা হয় বা নীরবে প্রতিস্থাপন করা হয় । এটি কেবল পক্ষপাতিত্ব নয়, বরং বিচারিক ক্ষমতার একটি পদ্ধতিগত অপব্যবহার, যা গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিকে ক্ষুণ্ণ করে।

বাংলাদেশে একটি স্পষ্ট 'দুই-স্তরের বিচার ব্যবস্থা' বিদ্যমান। আওয়ামী লীগ সমর্থকরা গ্রেপ্তার, জামিন প্রত্যাখ্যান এবং মিথ্যা অভিযোগের মুখোমুখি হন, অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত জোটের সদস্যরা 'অপর্যাপ্ত প্রমাণ'-এর অজুহাতে হত্যা ও অগ্নিসংযোগের মতো গুরুতর অপরাধ থেকেও খালাস পান। এটি রাজনৈতিক আনুগত্যের উপর ভিত্তি করে বিচার প্রদানের একটি 'গণনাকৃত প্রক্রিয়া' হিসেবে দেখা হয় । অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেও আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের 'স্বেচ্ছাচারী গ্রেপ্তার' এবং 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ' নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে, যা বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণের একটি পুনরাবৃত্তি নির্দেশ করে । এই পরিস্থিতি ইঙ্গিত করে যে, বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণ কেবল একটি নির্দিষ্ট দলের পক্ষপাতিত্ব নয়, বরং বিচারিক ক্ষমতাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের একটি গভীর সংস্কৃতি, যা প্রশাসনের পরিবর্তনের সাথে সাথে তার লক্ষ্য পরিবর্তন করে। যখন বিচার বিভাগ রাজনৈতিক প্রতিশোধের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন আইনের শাসন এবং রাষ্ট্রের বৈধতা মৌলিকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়, যা সমাজে ব্যাপক ভীতি এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।

বিচারপ্রাপ্তির সময়কাল: ধনী-গরিবের ভিন্ন চিত্র ও দীর্ঘসূত্রতার অভিশাপ

বাংলাদেশে বিচারপ্রার্থীরা আইনি প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হন, যার ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগে। এই দীর্ঘসূত্রতা কেবল একটি প্রশাসনিক সমস্যা নয়, বরং এটি দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যায়বিচারকে কার্যত অস্বীকার করে।

মামলার দীর্ঘসূত্রতার প্রধান কারণগুলো হলো:

মামলার জট (Backlog): আদালতের মামলা জট বিচার ব্যবস্থার একটি বড় বাধা। ব্র্যাক হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস (HRLS) এর তথ্য অনুযায়ী, তাদের দ্বারা দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলাগুলির ৭০ শতাংশ তিন বা তার বেশি বছর ধরে সাক্ষী শুনানির পর্যায়ে আটকে আছে। ২২ শতাংশ মামলা এক বা তার বেশি বছর ধরে তদন্ত পর্যায়ে এবং ৪ শতাংশ মামলা চার্জ শুনানির পর্যায়ে দুই বা তার বেশি বছর ধরে আটকে আছে । এই তথ্যগুলি বিচারিক প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে বিলম্বের ব্যাপকতা তুলে ধরে।

তদন্তে বিলম্ব: 
ফৌজদারি মামলায় তদন্ত পর্যায়ে বিলম্ব ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৭ সালের একটি অ্যাসিড সহিংসতার মামলায় চার্জশিট দাখিল করতে তিন বছর লেগেছিল, কারণ মূল তদন্তকারী কর্মকর্তা (IO) বদলি হয়েছিলেন এবং নতুন IO-কে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বিলম্ব হয়েছিল ।

বিচারকের অনুপস্থিতি ও মামলার অতিরিক্ত চাপ: চার্জ শুনানির পর্যায়ে বিচারকের অনুপস্থিতি বা এক দিনে অতিরিক্ত মামলার শুনানির কারণে নতুন শুনানির তারিখ পিছিয়ে যায় ।

সাক্ষী হাজির না হওয়া: 
সাক্ষী শুনানির পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে, কারণ সাক্ষীরা সময়মতো আদালতে হাজির হন না ।

কর্মকর্তাদের বদলি/অনুপস্থিতি: আদালত মুলতবি, মূল IO-এর বদলি, বিচারকের অনুপস্থিতি (বদলি বা পদোন্নতির কারণে) এবং IO ও মেডিকেল অফিসারের অনুপস্থিতি সাক্ষী শুনানির পর্যায়ে বিলম্বের কারণ ।

অপর্যাপ্ত সম্পদ ও অবকাঠামো: আদালত, পুলিশ এবং প্রসিকিউশন সংস্থার আর্থিক ও মানবসম্পদের ঘাটতি, সেইসাথে অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ বিচারিক ব্যবস্থায় ব্যর্থতার দিকে পরিচালিত করে ।

দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা: 
দুর্নীতি এবং আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে বিদ্যমান। আর্থিক সংস্থানের অভাব প্রায়শই বিচার প্রদানে বিলম্ব ঘটায়, এবং প্রক্রিয়া দ্রুত করার জন্য প্রায়শই ঘুষের প্রয়োজন হয় ।

ব্র্যাক হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস (HRLS) এর তথ্য অনুযায়ী, তাদের বিশ্লেষণ করা ৯৭টি ফৌজদারি মামলার মধ্যে ৭০ শতাংশ মামলা তিন বা তার বেশি বছর ধরে সাক্ষী শুনানির পর্যায়ে আটকে আছে। ২২ শতাংশ মামলা এক বছর বা তার বেশি সময় ধরে তদন্ত পর্যায়ে এবং ৪ শতাংশ মামলা দুই বছর বা তার বেশি সময় ধরে চার্জ শুনানির পর্যায়ে আটকে আছে। রায় প্রদানের পর্যায়েও ৪ শতাংশ মামলা দুই বছর বা তার বেশি সময় নিয়েছে । এই তথ্যগুলি বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিলম্বের সমস্যাটি কতটা ব্যাপক, বিশেষ করে সাক্ষী শুনানির পর্যায়ে। এই দীর্ঘসূত্রতা দরিদ্র ও প্রান্তিক বিচারপ্রার্থীদের জন্য ন্যায়বিচারের পথ অত্যন্ত 'কষ্টকর' করে তোলে । দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া তাদের জন্য আর্থিক ও মানসিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের পক্ষে দীর্ঘ সময় ধরে মামলা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে, ফলে তারা প্রায়শই ন্যায়বিচার ত্যাগ করতে বাধ্য হন বা প্রতিকূল ফলাফল মেনে নেন । ভূমি সংক্রান্ত মামলায়, গরিব ভূমি মালিকরা বছরের পর বছর ধরে মামলা চালিয়ে যেতে গিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হন, যা শেষ পর্যন্ত তাদের ভূমিহীন করে তোলে । এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, বিচার ব্যবস্থার অদক্ষতা এবং বিলম্ব দরিদ্রদের জন্য একটি কার্যকর বিচার প্রাপ্তির পথে বড় বাধা, যা তাদের আরও প্রান্তিক করে তোলে।

যদিও সুনির্দিষ্ট 'ধনীদের জন্য দ্রুত বিচার' এর উদাহরণ সরাসরি গবেষণা উপাদানে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়নি, তবে বিচারকের মন্তব্যের এবং দুর্নীতি ও প্রভাবের বর্ণনা থেকে এটি স্পষ্ট যে ধনীরা তাদের অর্থ ও প্রভাব ব্যবহার করে প্রক্রিয়াকে দ্রুত করতে পারে বা তাদের পক্ষে রায় পেতে পারে। 'উচ্চ-মূল্যের মামলা' বা 'রাজনৈতিক/ব্যবসায়ী' জড়িত মামলাগুলিতে 'অনুকূল রায়'-এর বিনিময়ে 'মোটা অঙ্কের অর্থ' প্রদানের প্রবণতা রয়েছে, যা দ্রুত নিষ্পত্তির ইঙ্গিত দেয় । এর মাধ্যমে, বিচারিক ব্যবস্থার অদক্ষতা এবং দীর্ঘসূত্রতা দরিদ্রদের জন্য ন্যায়বিচারের পথকে রুদ্ধ করে দেয়, যেখানে ধনীরা তাদের সম্পদ ব্যবহার করে এই বাধাগুলি অতিক্রম করতে পারে।

কাঠামোগত বৈষম্য ও দুর্নীতির গভীর শিকড়

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় কাঠামোগত বৈষম্য এবং দুর্নীতির শিকড় অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত, যা দশকের পর দশক ধরে সুশাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিচারিক দুর্নীতি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনে বাধা দিয়েছে এবং কার্যকর জবাবদিহিতা ব্যবস্থার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়েছে । প্রধান বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা এবং স্বয়ং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টও বিচারিক দুর্নীতির ব্যাপকতা স্বীকার করেছে । ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ২০২২ সালের দুর্নীতি ধারণা সূচক অনুযায়ী, দেশে দুর্নীতি বাড়ছে । এই দুর্নীতি আইনের শাসনকে গভীরভাবে ক্ষুণ্ণ করে এবং মানুষের ন্যায্য বিচার পাওয়ার অধিকার লঙ্ঘন করে ।

বিচারকদের জবাবদিহিতার একমাত্র সংস্থা, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল (SJC), ২০১৪ সালের সাংবিধানিক সংশোধনের পর 'অনিশ্চিত' অবস্থায় রয়েছে, যা সংসদকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দিয়েছিল। যদিও সুপ্রিম কোর্ট এই সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে SJC পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দিয়েছে, নির্বাহী বিভাগ একটি রিভিউ পিটিশন দায়ের করে SJC-তে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে । এই অচলাবস্থা বিচারিক জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে একটি গুরুতর শূন্যতা তৈরি করেছে। জবাবদিহিতার এই পক্ষাঘাতের কারণে দুর্নীতিবাজ বিচারকরা কার্যকর তদারকির অভাবে রয়েছেন, যা বিচার ব্যবস্থায় অনিয়ম ও দুর্নীতির বিস্তারকে উৎসাহিত করে। এর ফলে জন আস্থার আরও অবনতি ঘটে এবং আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে।

বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং দুর্নীতির কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, হেফাজতে নির্যাতন, এবং নির্বিচারে গ্রেপ্তার বা আটক । আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির জন্য ব্যাপক দায়মুক্তির অভিযোগ রয়েছে। সরকার এসব ঘটনা তদন্ত, বিচার ও শাস্তি প্রদানে খুব কম পদক্ষেপ নেয় । মানবাধিকার সংস্থাগুলো, যেমন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (ASK), হেফাজতে মৃত্যু এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়মিতভাবে নথিভুক্ত করে । উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের একটি ঘটনায়, সুলতানা জেসমিন র‍্যাব হেফাজতে মারা যান, এবং তার মৃত্যুর পর মামলা দায়ের করা হয়; হাইকোর্ট এই ঘটনায় জড়িত র‍্যাব কর্মকর্তাদের বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন । এই ধরনের ঘটনাগুলি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে তুলে ধরে।

বিচারকদের জবাবদিহিতার অভাব এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির জন্য ব্যাপক দায়মুক্তি একটি পদ্ধতিগত ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে ক্ষমতাশালী অভিনেতাদের জবাবদিহি করা হয় না। যখন বিচারিক বা আইন প্রয়োগকারী উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা তাদের কাজের জন্য কোনো পরিণতির মুখোমুখি হন না, তখন এটি একটি স্পষ্ট বার্তা দেয় যে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। এটি সরাসরি এই ধারণাকে শক্তিশালী করে যে আইন "ধনীদের জন্য নমনীয়" (যারা প্রভাব খাটাতে পারে) এবং "দরিদ্রদের জন্য কঠোর" (যারা আশ্রয়হীন এবং অপব্যবহারের শিকার)। এই পদ্ধতিগত দায়মুক্তিই বিচার ব্যবস্থায় পরিলক্ষিত বৈষম্যের মূল চালিকাশক্তি।

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে, বৈষম্য এবং শ্রেণিবিন্যাসের পক্ষপাতিত্ব নতুন ঘটনা নয়; এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আইনি বিকাশের গভীরে প্রোথিত। হিন্দু আমলে জাতিগত বৈষম্য থেকে শুরু করে মুসলিম আমলে ভিন্নধর্মী আচরণ এবং ব্রিটিশ শাসনামলে কাঠামোগত শ্রেণিবিন্যাসের সুদৃঢ়করণ, সবই বর্তমান কাঠামোগত বৈষম্যের কারণ । স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বিচারিক স্বাধীনতা ও সমতার লক্ষ্য থাকলেও, এই ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার সম্ভবত কাঠামোগত বৈষম্যের ধারাবাহিকতা এবং সংস্কারের প্রতি প্রতিরোধের কারণ।

সংস্কারের প্রচেষ্টা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান বৈষম্য ও দীর্ঘসূত্রতা নিরসনে বিচারিক সংস্কার কমিশন (JRC) বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ প্রস্তাব করেছে । এই সুপারিশমালাগুলি বিচার বিভাগের উন্নতি, বিলম্ব হ্রাস, দুর্নীতি দমন এবং ন্যায়বিচারে অভিগম্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে।

বিচারকের নিয়োগে স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্ব: 
JRC রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, মেধা-ভিত্তিক স্থায়ী সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা এবং সুপ্রিম কোর্ট বিচারক নিয়োগ কমিশন গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছে। বিচারক নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত করতে সংবিধান সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে । এই পদক্ষেপগুলি বিচারিক স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি: কমিশন বিভাগীয় সদর দফতরে স্থায়ী বেঞ্চ তৈরি, জেলা ও উপ-জেলা আদালত সম্প্রসারণ, এবং নতুন আদালত কক্ষ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। বিচারকদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং জাতীয় বিচারিক একাডেমি ও আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করে বিচার বিভাগের সক্ষমতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে । এই সংস্কারগুলি মামলার জট কমাতে এবং বিচারকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে আসতে সাহায্য করবে।

মামলার দীর্ঘসূত্রতা হ্রাস: 
মামলার জট কমাতে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, অনলাইন মামলা দাখিল ব্যবস্থা, এবং সাক্ষী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আরও কার্যকর কাঠামো তৈরি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিচারকদের ছুটি বা সরকারি ছুটির কারণে আদালতের কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়, তা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াও সুপারিশমালায় অন্তর্ভুক্ত । যদিও এই সুপারিশগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে একটি সমন্বিত কেস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ICMS) বাস্তবায়নের আগে ম্যানুয়াল কেস ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন করা অপরিহার্য । কারণ, যদি মৌলিক প্রক্রিয়াগুলি অদক্ষ হয়, তবে কেবল প্রযুক্তিগত সমাধান প্রয়োগ করে সমস্যার সমাধান হবে না, বরং তা বিদ্যমান সমস্যাগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

দুর্নীতি দমন: 
বিচারকদের জন্য আচরণবিধি, প্রতি তিন বছর অন্তর বাধ্যতামূলক সম্পদ বিবরণী প্রকাশ এবং সুপ্রিম কোর্টে দুর্নীতি রিপোর্টের জন্য অনলাইন অভিযোগ বক্স স্থাপন করার প্রস্তাব করা হয়েছে । এই ব্যবস্থাগুলি বিচারিক জবাবদিহিতা বাড়াতে এবং দুর্নীতি কমাতে সাহায্য করবে। তবে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের জরিপ অনুযায়ী, আদালতসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে দুর্নীতি এখনো ব্যাপক এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এর ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে । এটি ইঙ্গিত করে যে, দুর্নীতি একটি গভীর সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, যা কেবল আইনগত সংস্কারের মাধ্যমে সমাধান করা কঠিন।

আইনি সহায়তার উন্নতি ও অভিগম্যতা বৃদ্ধি: ই-বিচার ব্যবস্থা ও ই-ফাইলিং সিস্টেম চালু করে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, উন্নত আদালত সুবিধা (যেমন, সাক্ষীদের জন্য পৃথক বসার জায়গা, আসামিদের জন্য লোহার খাঁচা অপসারণ), বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR) পদ্ধতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং আইনি সহায়তা কর্মীদের প্রশিক্ষণ বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে । বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য একটি পৃথক বাজেট কমিটি গঠনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে ।

এই সুপারিশমালাগুলি বিচার ব্যবস্থার প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে স্পর্শ করেছে এবং একটি ন্যায়সঙ্গত ও কার্যকর বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য একটি বিস্তৃত পথনির্দেশনা প্রদান করে। তবে, এই ব্যাপক সংস্কারগুলি বাস্তবায়ন করা একটি বিশাল এবং চ্যালেঞ্জিং কাজ, যার জন্য দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর কাছ থেকে প্রতিরোধের মোকাবিলা করার ক্ষমতা প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ক্ষতি পূরণের অঙ্গীকার করলেও , রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিচার বিভাগের অব্যাহত রাজনৈতিকীকরণ এই সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান বৈষম্য একটি গভীর এবং পদ্ধতিগত সমস্যা, যা ধনী ও গরিবের মধ্যে স্পষ্ট বিভেদ তৈরি করেছে। অর্থের ক্ষমতা, দুর্বল আইনি সহায়তা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং বিচারিক দীর্ঘসূত্রতা সম্মিলিতভাবে ন্যায়বিচারের ধারণাকে ক্ষুণ্ণ করছে। বিচারপতিদের অকপট স্বীকারোক্তি, মানবাধিকার সংস্থাগুলির প্রতিবেদন এবং গবেষণামূলক তথ্যপ্রমাণ সবই এই নির্মম বাস্তবতাকে তুলে ধরে।

বিচার ব্যবস্থা কেবল আইনি বিধানের সমষ্টি নয়; এটি একটি সমাজের ন্যায়, সমতা এবং জবাবদিহিতার প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। যখন এই ব্যবস্থা অর্থের কাছে নতি স্বীকার করে, রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং দীর্ঘসূত্রতার জালে আবদ্ধ হয়, তখন তা কেবল ব্যক্তিবিশেষের প্রতি অবিচার করে না, বরং রাষ্ট্রের বৈধতা এবং জনগণের আস্থাকেও মৌলিকভাবে ক্ষুণ্ণ করে।

এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলায় বিচারিক সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা একটি আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে, এই ব্যাপক সংস্কারগুলি কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এগুলির সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, জবাবদিহিতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম। একই সাথে, আইনি সহায়তার পরিধি ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি, মামলার জট কমানো এবং বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা অপরিহার্য।

ন্যায়বিচার কেবল একটি অধিকার নয়, এটি একটি সমাজের ভিত্তি। বাংলাদেশের জন্য, ন্যায়বিচারের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে, আইনকে সত্যিই সকলের জন্য সমান করতে হবে – ধনী বা গরিব নির্বিশেষে। এটি কেবল একটি আইনি সংস্কার নয়, বরং একটি সামাজিক বিপ্লবের ডাক, যেখানে প্রতিটি নাগরিক আইনের চোখে সমান সম্মান ও সুরক্ষা পাবে।
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় বৈষম্য ও ন্যায়বিচারের সংকট | KalpaKatha360

Post a Comment

🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।

শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com

Previous Post Next Post