বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ হওয়া সত্ত্বেও কৃষকরা প্রতিনিয়ত অবহেলিত। ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঋণ এবং সরকারি সহায়তার অভাব—এসব কারণে কৃষকদের জীবন সংগ্রামে জর্জরিত। এই পোস্টে কৃষকদের দুর্দশার কারণ এবং সম্ভাব্য প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ, একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, যার অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো কৃষি। এদেশের প্রায় ৮০% মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ধান, পাট, গম, ভুট্টা, শাক-সবজি আর ফলমূলের ফলনে এদেশের উর্বর মাটি বরাবরই সমৃদ্ধ। তবুও প্রশ্ন জাগে, যে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষক, সে দেশের কৃষকেরাই কেন সবচেয়ে বেশি অবহেলিত? কেন তাদের ঘামে ভেজা ফসলের ন্যায্য মূল্য মেলে না? কেন তাদের জীবন প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তা আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে? আজকের এই পোস্টে আমরা কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের কৃষকদের অবহেলার কারণগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করব এবং এর সম্ভাব্য প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব।
কৃষকদের অবহেলার মূল কারণসমূহ
বাংলাদেশের কৃষকদের অবহেলার পেছনে বেশ কিছু জটিল কারণ জড়িত, যা একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা তৈরি করেছে।
১. ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া
এটি কৃষকদের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলায়, কিন্তু বিক্রির সময় মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। উৎপাদন খরচ বাড়লেও সে অনুযায়ী ফসলের দাম বাড়ে না। অনেক সময় বাজারে পণ্যের সরবরাহ বেশি থাকলে দাম এতটাই কমে যায় যে কৃষকের উৎপাদন খরচও ওঠে না। ফলে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে অনেক কৃষক।
২. প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার
বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি – এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষকের সারা বছরের পরিশ্রম এক নিমিষেই শেষ করে দেয়। ফসলহানির পর কৃষকদের পুনর্বাসনের জন্য পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা প্রায়শই অপ্রতুল থাকে। অনেক সময় ঋণ করে ফসল ফলানোর পর দুর্যোগে সব হারানোর ফলে কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে।
৩. কৃষি ঋণের বোঝা
কৃষি কাজের জন্য কৃষকদের প্রায়শই ঋণের প্রয়োজন হয়। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিতে নানা ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক কৃষক সহজ শর্তে ঋণ না পেয়ে বাধ্য হয়ে উচ্চ সুদে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নেয়। ফসল নষ্ট হলে বা ন্যায্য মূল্য না পেলে এই ঋণের বোঝা পাহাড়সম হয়ে দাঁড়ায়, যা অনেক সময় কৃষকের আত্মহত্যার কারণও হয়ে দাঁড়ায়।
৪. আধুনিক প্রযুক্তির অভাব ও ব্যবহার না জানা
বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক এখনো সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি, উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশক ব্যবহারের জ্ঞান এবং সামর্থ্যের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হয়। সরকারিভাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করলেও তা তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকদের কাছে পৌঁছাতে অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। ফলে উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশের কৃষকের উৎপাদনশীলতা কম থাকে।
৫. বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার দুর্বলতা
কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণের দুর্বল ব্যবস্থাপনা কৃষকদের জন্য আরেকটি বড় সমস্যা। উৎপাদিত পণ্য সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। পরিবহনের খরচ বেশি, গ্রামীণ রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, হিমাগারের অভাব এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেট – এসব কারণে কৃষক তার পণ্যের সঠিক মূল্য পায় না। অনেক সময় ফসল ক্ষেতেই পচে যায়, কারণ বাজারে নেওয়ার খরচই বেশি পড়ে।
৬. সরকারি নীতির সীমাবদ্ধতা ও প্রয়োগের অভাব
কৃষকদের জন্য সরকার বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন প্রায়শই দেখা যায় না। যেমন, সারে ভর্তুকি দেওয়া হলেও অনেক সময় সার প্রাপ্তিতে জটিলতা দেখা যায়। কৃষি পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা হলেও তা অনেক সময় কার্যকর হয় না। কৃষকদের জন্য বীমা ব্যবস্থার অপ্রতুলতাও একটি বড় সমস্যা।
৭. ভূমি অধিকার ও ভূমির খণ্ডীকরণ
জমির মালিকানা নিয়ে জটিলতা, ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং কৃষি জমির খণ্ডীকরণও উৎপাদন ব্যাহত করে। ছোট ছোট জমিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়ে, যা উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দেয় এবং লাভ কমায়।
৮. শিক্ষার অভাব ও সচেতনতার অভাব
অনেক কৃষকই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ফলে তারা কৃষি প্রযুক্তির নতুন দিকনির্দেশনা, সরকারি সুবিধা বা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। এই অজ্ঞতা তাদের আরও বেশি শোষিত হতে সাহায্য করে।
কৃষকের অবহেলিত জীবন: কিছু চিত্র
একজন কৃষকের জীবন কতটা সংগ্রামমুখর, তা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা দেখলে স্পষ্ট হয়।
ভোরে ওঠা:
ভোর হওয়ার আগেই তাদের দিন শুরু হয়। জমিতে যাওয়া, হালচাষ করা, বীজ রোপণ করা, সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করা, সেচ দেওয়া – প্রতিটি কাজই কায়িক শ্রমের চূড়ান্ত উদাহরণ।
রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা:
প্রচণ্ড গরম, ঝড়-বৃষ্টি বা হাড় কাঁপানো শীত – কোনো কিছুই কৃষকের কাজকে থামাতে পারে না। প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেই তাদের ফসল ফলানোর কাজ চালিয়ে যেতে হয়।
অনিশ্চিত আয়:
সারা বছর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করার পরও ফসলের মূল্য নিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা কাজ করে। ভালো ফলন হলেও বাজারে ন্যায্য মূল্য পাওয়া নিয়ে চিন্তা থেকেই যায়।
ঋণের বোঝা:
অনেক কৃষকই ঋণের জালে জড়িয়ে থাকেন। ফসল ভালো না হলে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সব হারালে তাদের জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
সামাজিক মর্যাদা:
সমাজের চোখে কৃষকদের মর্যাদা তুলনামূলকভাবে কম। অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি কৃষি কাজকে সম্মানজনক মনে করেন না, যা কৃষকদের আরও বেশি অবহেলিত করে তোলে।
সমাধানের পথ: কিভাবে কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো যায়?
কৃষকদের এই অবহেলিত জীবন থেকে মুক্তি দিতে এবং দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
১. ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণ
সরকারি ক্রয় কেন্দ্র বৃদ্ধি: সরকারিভাবে ধান, গমসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কেনার জন্য প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় পর্যাপ্ত ক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
সরাসরি বাজারজাতকরণ: মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে কৃষক যাতে সরাসরি ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারে, সে ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য সমবায় ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে।
নূন্যতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ: উৎপাদনের খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP) নির্ধারণ করতে হবে এবং তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
২. কৃষি ঋণের সহজলভ্যতা ও সুদের হার কমানো
সহজ শর্তে ঋণ: ব্যাংকগুলো থেকে কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে এবং কম সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
কিষান কার্ড: সকল কৃষককে কিষান কার্ডের আওতায় এনে ঋণের প্রক্রিয়া আরও সহজ ও স্বচ্ছ করতে হবে।
ঋণ মওকুফ: প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানির ক্ষেত্রে কৃষকদের ঋণের বোঝা লাঘবে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ঋণ মওকুফের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৩. আধুনিক কৃষিতে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা
প্রশিক্ষণ: কৃষকদের আধুনিক কৃষি পদ্ধতি, উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশক ব্যবহার এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার সম্পর্কে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ: কৃষি গবেষণায় আরও বেশি বিনিয়োগ করে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে যা রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী এবং উচ্চ ফলনশীল।
আধুনিক যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা: ভর্তুকি মূল্যে বা সহজ কিস্তিতে কৃষকদের কাছে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন – ট্রাক্টর, রিপার, ড্রায়ার ইত্যাদি সহজলভ্য করতে হবে।
৪. কৃষি বীমা ব্যবস্থা চালু করা
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষি বীমা ব্যবস্থা চালু করা অত্যন্ত জরুরি। এটি কৃষকদের আর্থিক সুরক্ষা দেবে এবং তাদের দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম করে তুলবে।
৫. কৃষি বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন
হিমাগার স্থাপন: প্রতিটি কৃষি অঞ্চলে পর্যাপ্ত হিমাগার স্থাপন করতে হবে যাতে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণ করে ভালো দামে বিক্রি করতে পারে।
পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন: গ্রামীণ রাস্তাঘাট উন্নত করা এবং কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা।
তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার: কৃষি পণ্যের বাজার মূল্য সম্পর্কে কৃষকদের নিয়মিত তথ্য সরবরাহ করতে হবে, যাতে তারা পণ্যের সঠিক মূল্য সম্পর্কে অবগত থাকে। মোবাইল অ্যাপ বা এসএমএসের মাধ্যমে এই তথ্য প্রদান করা যেতে পারে।
৬. সরকারি নীতি ও সহায়তার কার্যকর বাস্তবায়ন
কৃষকদের জন্য প্রণীত সকল সরকারি নীতি ও কর্মসূচি যেন তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকদের কাছে পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি ভর্তুকি, সার ও বীজের সরবরাহ যেন সময়মতো ও সুষ্ঠুভাবে হয়, তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
৭. কৃষকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি
কৃষি কাজকে সম্মানজনক পেশা হিসেবে তুলে ধরতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় কৃষির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং কৃষকদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে – এই চিরন্তন সত্যটি অনুধাবন করা আমাদের সকলের জন্য জরুরি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষকদের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের কঠোর পরিশ্রমের ফসল আমাদের খাদ্যের যোগান দেয় এবং দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। কৃষক যদি অবহেলিত থাকেন, তাদের জীবন যদি অনিশ্চয়তায় ঘেরা থাকে, তাহলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।সরকার, বেসরকারি সংস্থা, এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কৃষকদের দুর্দশা লাঘব করা সম্ভব। কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, তাদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শেখানো এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তা করা – এসবের মাধ্যমেই আমরা কৃষকদের মুখে হাসি ফোটাতে পারি। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ truly সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হতে পারে। কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার কোলে ঢুকে পড়েছে। শহরের বাতাসে আজ যেন একটা অস্থিরতা। শাহবাগ মোড়ে আজও জমেছে হাজারো মানুষের ভিড়—প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন আর গলায় রাগ আর হতাশার কণ্ঠ। কারও হাতে লেখা—
"নির্বাচন নয়, রক্ত চায় তারা!"
"গণতন্ত্রের নামে খেলা বন্ধ করো!"
২০ বছর বয়সী আরাফাত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, এই আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় মুখ। চোখে আগুন, বুকভরা প্রশ্ন আর হাতে একটা ছোট্ট ডায়রি—যেখানে সে তার স্বপ্ন আর ক্ষোভ লিখে রাখে।
"আমার বাবাও আন্দোলন করেছিল ১৯৯০-এ। স্বৈরাচার হটানোর জন্য। আজ আমি কেন রাস্তায়?"—জোরে জোরে বলছিল সে।
তার পাশে থাকা রুমানা, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী, বলল—"তোমাদের পরিবারে শুধু সরকার আসে আর যায়, কিন্তু আমাদের পরিবারে প্রতিবার একটা মানুষ হারিয়ে যায়—গুম হয়ে যায়, নিখোঁজ হয়, গ্রেফতার হয়।"
এদিকে রাস্তার পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ হাশেম সাহেব, এক সময়কার মুক্তিযোদ্ধা, আজ চোখ ভেজান এই তরুণদের দেখে। “এই কি চেয়েছিলাম আমরা? স্বাধীনতা এনে এই অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করতে?”
বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পল্টন, মতিঝিল, প্রেসক্লাব, এমনকি উত্তরবঙ্গের ছোট শহরগুলোতেও। ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, দিনমজুর—সবাই যেন একটিই শব্দে গলা মিলিয়েছে: পরিবর্তন চাই!
পঞ্চগড়ের সেই ছোট্ট গ্রাম—ভেলাগাঁও। এখানেই শুরু হয়েছিল ‘প্রধান’ হওয়ার খেলা। যারা একসময় মাঠে-ঘাটে কৃষিকাজ করতো, তারা এখন পাজেরো আর ফেইসবুক লাইভে ব্যস্ত। কিন্তু পেছনের গল্পটা?
বছরের পর বছর একটা ভোট ঘিরে কীভাবে দুই পরিবার, দুই গোত্র, দুই বন্ধুত্ব চির শত্রুতে রূপ নিলো, তারই বর্ণনা এই পর্বে। এখানে কোনো আদর্শ নেই, শুধু ব্যক্তিগত লাভ—কে কত টেন্ডার নেবে, কার কত লোক বিআরডিবিতে চাকরি পাবে, তার লড়াই।
প্রার্থীর হাসি মুখে সাদা পাঞ্জাবি, ভেতরে ষড়যন্ত্রের বিষাক্ত ছুরি।
ভেলাগাঁওয়ের আবু তালেব মেম্বার—যিনি একসময় সত্যিকারের সমাজসেবক ছিলেন, আজ তাকেই দেখা গেলো থানা ও নেতার পেছনে দৌড়াতে, কারণ তিনি ‘বিরোধী’ শিবিরে।
আর সোহেল চেয়ারম্যান, যিনি গতবার ক্ষমতায় এসেছিলেন বিশাল প্রতিশ্রুতি নিয়ে, এবার ভোটের আগে শুধু ঘুষের টাকায় ভোট কিনছেন, অথচ চৌরাস্তার রাস্তাটা এখনো ভাঙাচোরা।
এই অধ্যায়ে উঠে আসে নির্বাচন নামের নাটকের আড়ালের ‘ডিরেক্টর’রা। কিভাবে একটি গ্রামের মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নেয় শহরের নেতারা। ভেলাগাঁও যেন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
এখানে ভোট মানে ‘ভোটার'দের ভাগ্যে কিচ্ছু নেই। আছে শুধু লাঠি, মামলা, মিথ্যা অভিযোগ আর বস্তাভর্তি টাকার খেলা।
গ্রামের কৃষক রফিক মিয়া প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে মাঠে যান। বংশ পরম্পরায় তিনি চাষবাসই করে আসছেন। কিন্তু এবার যখন ধান কেটে হাটে নিয়ে গেলেন, কেজিপ্রতি দাম পেলেন মাত্র ১২ টাকা! অথচ উৎপাদন খরচ পড়েছে প্রায় ২০ টাকা কেজিতে।
"বেঁচে থাকি কীভাবে?" — রফিক মিয়ার চোখে পানি।
অথচ গ্রামের মোড়ল সাহেবের ছেলে শহরে যায় SUV গাড়ি কিনতে। তার বাবা ‘দলীয় পদ’ ব্যবহার করে সরকারি অনুদান, কৃষি ঋণ, এমনকি দুর্যোগ সহায়তার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
ফুটে ওঠে—
👉 কৃষকের ন্যায্য দাম না পাওয়া,
👉 বাজারে সিন্ডিকেটের আধিপত্য,
👉 সরকারি প্রকল্পের টাকা লোপাট,
👉 ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের দমিয়ে রাখা।
একই সাথে দেখা যায়, ভেলাগাঁওয়ের পাশেই নতুন একটি ‘কৃষি প্রজেক্ট’ চালু হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। কোটি টাকার বাজেট। কিন্তু স্থানীয়দের কেউ জানেই না এই প্রকল্পে তাদের কোনো ভূমিকা আছে কি না। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতোই অবস্থা।
“বাংলাদেশ যদি কৃষিনির্ভর দেশ হয়, তবে কৃষক কেন সবচেয়ে অবহেলিত?”
ভেলাগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরনো টিনের ছাউনি ভেঙে পড়ে আছে বহুদিন। ক্লাসে নেই যথেষ্ট বেঞ্চ, শিক্ষকের সংখ্যাও কম। অথচ কাগজে-কলমে দেখা যায়, স্কুলের জন্য কয়েক লাখ টাকার ‘উন্নয়ন বরাদ্দ’ এসেছে।
হেডমাস্টার সাহেব দপ্তরে চা খেতে খেতে বলেন, “উপরে খাইয়ে দিতে হয়, না হলে কিছুই হয় না।”
📚 গ্রামের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে আসে, কিন্তু পাঠ্যবই থাকে সীমিত, শিক্ষকের মনোযোগ আরও সীমিত।
📚 প্রাইভেট না পড়লে পাসই মুশকিল—এমন বার্তা এখন শিক্ষকদের মুখেই শোনা যায়।
অন্যদিকে পাশের ইউনিয়নে নতুন একটি হাইস্কুল হচ্ছে—শুধু রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা এক নেতার নামে। সেই স্কুলে এখনও ক্লাস শুরু হয়নি, তবুও শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। মাস গেলে সবাই বেতন তোলেন নিয়মমতো।
✅ কীভাবে নীতির নামে নীতিহীনতা চর্চা হয়,
✅ কীভাবে গরিবের সন্তানদের শিক্ষার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়,
✅ আর কীভাবে রাজনীতিকরা শিক্ষাকে বানিয়ে ফেলেন পুঁজি।
শেষে গ্রামের তরুণ মেহেদি বলে ওঠে:
“আমরা কি কখনো শিখতে পারবো, নাকি শুধু রাজনীতির সিঁড়ি হবো?”
এই অধ্যায়ে আমরা যাবো ভেলাগাঁও কমিউনিটি ক্লিনিকে—যেখানে চিকিৎসা নেই, ওষুধ নেই, অথচ মন্ত্রীসভার রিপোর্টে বলা হয় ‘সকল সেবা নিশ্চিত।’
কৃষক অবহেলিত, বাংলাদেশের কৃষি সমস্যা, কৃষকের দুর্দশা, ফসলের ন্যায্য মূল্য, কৃষি ঋণ, সার সংকট, সেচ সমস্যা, কৃষকদের অধিকার, কৃষি নীতি, কল্পকথা৩৬০, বাংলাদেশ কৃষি।
ভূমিকা