যে ভালোবাসা ছুঁয়ে দেখিনি


যে ভালোবাসা ছুঁয়ে দেখিনি" একটি হৃদয়বিদারক বাংলা প্রেমগল্প, যেখানে একজন গরিব, অশিক্ষিত তরুণ তার ভালোবাসার মানুষকে পবিত্র রাখতে নিজেকে সংযত রাখে। ভালোবাসার আবেগ, ত্যাগ, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সমাজের বৈষম্য গল্পটিকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। মেয়েটি একসময় তার শরীর সঁপে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সে ছুঁয়ে দেখেনি—ভেবেছিল, ভালোবাসা মানে সম্মান। বছর পেরিয়ে মেয়েটি ভুলে যায়, অন্য কাউকে বিয়ে করে, অথচ সেই তরুণ আজও বয়ে বেড়ায় সেই অসমাপ্ত প্রেমের স্মৃতি। যারা বাংলা প্রেমগল্প, বেদনাময় প্রেম, এবং আত্মত্যাগের কাহিনি পড়তে ভালোবাসেন, তাদের জন্য এটি এক অনন্য গল্প। পড়ুন, অনুভব করুন, আর ভাবুন—ভালোবাসা কি কেবল স্পর্শে প্রকাশ পায়?

ছোট শহরের ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যখন বাড়ি ফিরছিলাম, তখনও বুঝিনি আমার জীবনের সবচেয়ে গভীর দুঃখটা একদিন এই পথেই নামবে। শহরের শেষ প্রান্তে একটা রেললাইন, তার পাশেই আমার ছোট্ট দোচালা ঘর। বাবা-ছেলে মিলে এক কাপড়ে দিনের পর দিন চায়ের দোকান চালিয়ে যাচ্ছি। বাবা বলতেন, “সৎভাবে চল ছেলে, মানুষ হ।” আমি কেবল একবার বলেছিলাম, “মানুষ হতে গেলে কি টাকা দরকার হয়?” বাবা হেসে বলেছিলেন, “না, মন দরকার।”

সেই মনটাই একদিন দিয়ে ফেলেছিলাম একজনকে। নাম তার নীলা।

আমি তখন ক্লাস নাইনে, আর নীলা এই মাত্র ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয়েছে। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে একদিন দেখি এক মেয়ে কান্না করছে গেটের সামনে। জানতে পারলাম, তার মা আসেনি নিতে। আমি বললাম, “চলো, আমি পৌঁছে দিই।” সে চমকে উঠে পেছনে তাকাল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, “তুমি কে?”

“আমি শুভ। ওই পাশে থাকি। ভয় নেই, আমি কিছু করব না।”

সেদিন তাকে পৌঁছে দিতে গিয়ে জানলাম, ওদের পরিবার শহরের নতুন বাসিন্দা। বাবা অফিসার, মা স্কুলশিক্ষিকা। ছিমছাম, ভদ্র ঘর। ওদের ড্রয়িংরুমে ঢুকতে ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু নীলা আমার হাত চেপে ধরে বলল, “ভয় পেও না। তুমিও তো মানুষ।”

সেই দিন থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। সকাল হলে আমি নীলার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, আর সন্ধ্যায় আমার দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যেত সে, কখনো কখনো এক কাপ চাও খেয়ে নিতো।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা বড় হতে লাগলাম। আমি দোকানে কাজ করতে করতে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম, আর নীলা শহরের সেরা স্কুলে ভর্তি হলো। ওর রেজাল্ট ভালো, শিক্ষকরা আদর করে। আমি কেবল দূর থেকে দেখি, কাছে ঘেঁষতে সাহস হয় না। কিন্তু মাঝে মাঝে আমাদের দেখা হতো। কখনো স্কুলের বারান্দায়, কখনো শহরের বইমেলায়।

একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম, “তুই অনেক সুন্দর।”

নীলা হেসে বলল, “এটা ভালোবাসার প্রস্তাব না তো?”

আমি চমকে গিয়ে বললাম, “না, আমি তোকে সম্মান করি। ভালোবাসার জায়গাটায় থাকিস তুই।”

সেদিন সে বলেছিল, “তুই ভালো ছেলে। একদিন ডাক্তার হবো আমি, তুই আমার পাশে থাকবি তো?”

আমি বলেছিলাম, “যে রোজার দিনে ইফতারের জন্য অপেক্ষা করে, সে তো ঠিকই ভরপেট খায়। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করব।”

নীলা কলেজে উঠলো। আমি পড়ালেখা ছাড়লাম। দোকানে পুরো সময় দিতে লাগলাম। কারণ জানতাম, ওর ফর্ম ফিলআপ, প্রাইভেট পড়া, পরীক্ষার ফি—সবই টাকার খেলা। ও কাউকে বলেনি, কিন্তু আমিই জেনেছিলাম তার প্রয়োজন। আমি রোজ আমার মজুরি জমিয়ে রাখতাম। রাতে দোকান বন্ধ করে গোপনে গিয়ে দিতাম সেই টাকা।

একদিন নীলা বলল, “তুই কি পাগল? তোর নিজের জীবন আছে না?”

আমি বললাম, “তোকে মানুষ করতে পারলেই আমার জীবন ধন্য।”

ও চোখে জল নিয়ে বলেছিল, “তুই আমাকে ভালোবাসিস?”

আমি বলেছিলাম, “অভিমান করে বললে তোকে ছুঁয়ে দেখব, কিন্তু ভালোবেসে নয়।”

সে বলেছিল, “বিয়ে করবি?” আমি বলেছিলাম, “তুই ডাক্তার হ না হ, আমি তোরই হবো।”

নীলা মেডিক্যালে চান্স পেল। শহরের বাইরে চলে গেল। যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ফোন আর মাঝে মাঝে দেখা। আমি ওকে দেখতে যেতাম। হোস্টেলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একবার গিয়েছিলাম, সে আসেনি। বলেছিল, “আজ ক্লাস আছে।” আমি ফিরেছি চুপচাপ, ব্যাগে রাখা তার পছন্দের বইটি রেখে দিয়েছি ওর মেইনগেটে।


নীলা তার শরীরটা আমাকে যে কতবার সঁপে দিতে চেয়েছিল, তা সংখ্যায় বলে বোঝানো যাবে না।
অনেকবার, অনেক মুহূর্তে… সে চাইত আমি তাকে জড়িয়ে ধরি, চেপে ধরি বুকে। চাইত আমি তাকে শুধু চোখে নয়, গায়ে গায়ে অনুভব করি। কিন্তু আমি ছুঁইনি।




না, কারণ আমি তাকে ভালোবাসতাম মন দিয়ে, হৃদয় দিয়ে। শরীর দিয়ে ভালোবাসা আমার ভালোবাসার সংজ্ঞার সঙ্গে যায় না।
আমার সেই ভালোবাসার মাপকাঠি ছিল—পবিত্রতা। আমি চাইনি আমার ভালোবাসা একদিন কোনো অনুশোচনার ভার বহন করুক। আমি চেয়েছিলাম, নীলা যেন একদিন নিজের অতীত মনে করে গর্ব করতে পারে, লজ্জা নয়।

তাই ওর আবেগের রাতগুলোতে, আমি বারবার নিজেকে থামিয়েছি। কখনো বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়ানো ওর কান্না শুনেও ঘরে যাইনি। কখনো বলিনি, “এসো…”
বলেছি, “নীলা, প্রেম মানে শরীর নয়। প্রেম মানে অপেক্ষা।”

সে হয়তো ভেবেছিল আমি কাপুরুষ। কিংবা অনভিজ্ঞ।
কিন্তু না, আমি শুধু চেয়েছিলাম ওর চেয়ে উঁচু কিছু। চেয়েছিলাম ওর আকাশ হোক পরিষ্কার, দাগহীন।

নীলা ছিল সাহসী, আত্মবিশ্বাসী, নিজের শরীরের স্বাধীনতা নিয়ে গর্বিত। ওর ধারণা ছিল, ভালোবাসা মানে শরীরের প্রকাশ। আমি ছিলাম রক্ষণশীল, কিন্তু ভন্ড না। আমি শুধু চেয়েছিলাম, ও আমার প্রতি যেটুকু বিশ্বাস করেছে, আমি তা ধরে রাখি।

কিন্তু সময় সবকিছু বদলায়।
যে সময়টায় আমি এক কাপ চায়ের দোকান চালিয়ে টাকাটা জমাতাম ওর পড়াশোনার খরচে, সেই সময়েই সে নতুন শহরে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে বদলে যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে ফোনের ও প্রান্ত থেকে কথা কমে গেল। আমি বুঝলাম, আমার ছুঁয়ে না দেখার পবিত্রতা তাকে ধীরে ধীরে করে তুলেছে দূরের।

তারপর একদিন জানতে পারলাম, সে বিয়ে করছে। এক বড়লোক ডাক্তার ছেলেকে।

আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম:
“তুই ভুলে গেলি সব?”
সে বলেছিল, “ভালোবাসা দিয়ে জীবন চলে না শুভ। তুই ভালো ছেলে, কিন্তু শুধু ভালো থাকলেই হয় না।”

আমি হেসেছিলাম সেদিন।
বলেছিলাম, “তুই চেয়েছিলি আমি তোকে ছুঁই। আমি তো চেয়েছিলাম তোকে সম্মান করি। দেখ, আমি কোনটায় হেরে গেলাম।”

সে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। হয়তো লজ্জায়, হয়তো অভিমান থেকে।

আমার ভিতরটায় তখন একটাই কথা ঘুরছিল—
আমি যদি তাকে ছুঁয়ে দিতাম, যদি নিজের ভালোবাসাকে শরীর দিয়ে প্রকাশ করতাম, তবে কি সে থেকে যেতো?
তবে কি প্রমাণ হতো যে আমি তাকে ভালোবাসি?
না।
তাহলে ভালোবাসার মানে শুধু ছোঁয়া হয়ে যেতো।
যার হৃদয় ছিলাম আমি, সে হয়তো তখন শুধু এক শরীরের হিসাব রাখত।

তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক—যাকে আমি স্পর্শ করিনি, সে-ই আজ আমায় ভুলে গেছে।
সে-ই আজ আমার অবিচার করেছে।
আমার নিঃস্বার্থ প্রেমকে ফিরিয়ে দিয়েছে এক বুক কষ্ট—না পাওয়ার অফুরন্ত ব্যথা।

আজ নীলার ছবি দেখি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সে হাসছে, দামী গাড়িতে ঘুরছে, বিদেশে কনফারেন্সে যাচ্ছে।
আমি সেই পুরনো চায়ের দোকানেই বসে থাকি, প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা এক কাপ চা বানাই।
কেউ জানে না, সেই চা বানানোর সময় আমার মন পড়ে থাকে সেই দিনগুলোর দিকে—যেখানে এক মেয়ে বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমার ছোঁয়ার জন্য অপেক্ষা করত।
আর আমি তাকে ছুঁইনি।
কেবল ভালোবেসে পবিত্র রাখতে চেয়েছিলাম।

আজও আমি তাকে দোষ দিই না।
কারণ, আমি জানি, ওর চোখে ভালোবাসার সংজ্ঞা ছিল ভিন্ন।
কিন্তু আমার চোখে আজও প্রেম মানে—অপেক্ষা, আত্মত্যাগ আর নিঃশব্দে ফিরে যাওয়া।

আজও চুপিচুপি বলি,
“নীলা, তোকে ছুঁইনি বলে হয়তো তুই ভুলে গেছিস।
কিন্তু জানিস, ছুঁয়ে দিলে হয়তো তোকে হারানোর ভয়টাই বেড়ে যেত।”

ধীরে ধীরে সে বদলাতে লাগল। ফোন কমে গেল। দেখা দূরের কথা, উত্তরও দিত না। একদিন ফেসবুকে দেখলাম, সে এক অনুষ্ঠানে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক ছেলের সঙ্গে। ক্যাপশন: “With my best decision ever.”

আমি মেসেঞ্জারে লিখলাম, “এত সহজে ভুলে গেলে?”

উত্তরে সে লিখল, “ভালোবাসা দিয়ে জীবন চলে না শুভ। তুই ভালো থাক।”

আমি গেলাম ওর কাছে। কলেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম ঘণ্টাখানেক। শেষে সে এল। চোখে সানগ্লাস, হাতে দামি মোবাইল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুই কি সত্যিই আমাকে ভুলে গেছিস?”

সে বলল, “শুভ, আমার পরিবার চায় না আমি একজন চা-ওয়ালার সঙ্গে জীবন কাটাই। তুই অশিক্ষিত। আমি একজন নামী সার্জনের সঙ্গে বিয়ে করতে যাচ্ছি।”

আমি বললাম, “তুই তো জানিস আমার পড়ালেখা কেন থেমে গেছে। তোকে মানুষ করতেই তো আমি নিজেকে বিসর্জন দিয়েছি।”

সে বলল, “তুই তো আমাকে ছুঁসওনি কখনও। কোনো প্রমাণ নেই তোর ভালোবাসার।”

সেদিন আমার ভেতরে সবকিছু ভেঙে গিয়েছিল। আমি যাকে পবিত্র রাখার জন্য স্পর্শ করিনি, সে-ই আজ আমাকে অবজ্ঞার চোখে দেখে।

বিয়ের দিন ওর বাড়ির সামনে গিয়েছিলাম। দূর থেকে তাকিয়েছিলাম। নীলা হাসছিল, গায়ে হলুদের পিঁড়িতে বসে। লোকজন বলাবলি করছিল, “ভাগ্য ভালো মেয়েটার! ডাক্তার বিয়ে করছে!”

আমার মনে হলো, আমি যেন নিজের ছায়াকেও হারিয়ে ফেলেছি। ফিরে এসে নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ভালোবাসা কি একতরফা হতে পারে?”

আজ ৬ বছর হয়ে গেছে। আমি সেই পুরনো চায়ের দোকানেই কাজ করি। মাঝে মাঝে নতুন ছাত্রছাত্রীরা আসে, গল্প করে, প্রেম করে। আমি হাসি, আর ভেতরে ভাঙি।

কখনো কখনো বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি, যেখানে একদিন নীলা নিজেকে আমার কাছে সমর্পণ করতে চেয়েছিল। আমি তা ফিরিয়ে দিয়েছিলাম পবিত্রতার নামে। আজ মনে হয়, ছুঁয়ে দিলে হয়তো কিছু স্মৃতি তৈরি হতো।

নীলা এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিত মুখ। তার হাসিমাখা ছবি দেখি, আর ভেতরে কাঁদি। কেউ জানে না, তার জন্য কেউ নিজের সব কিছু বিসর্জন দিয়েছিল।

সব ভালোবাসার গল্পে নায়ক থাকে না, কিন্তু প্রতিটি হারানো গল্পে একটা গভীর উপলব্ধি থাকে। আমি শুভ, এক অশিক্ষিত চা-ওয়ালা, যে শুধু চেয়েছিল একটি মেয়েকে তার স্বপ্নে পৌঁছে দিতে। আজ সে মেয়েটা ডাক্তার, আর আমি—একটা হারানো নাম।

ভালোবাসা যদি প্রমাণ চায়, তাহলে নিঃস্বার্থ প্রেমের আর কোনো মূল্য থাকে না। নীলা ভুলে গেল, কিন্তু আমি আজও ওর জন্য এক কাপ চা ফোটাই, নিঃশব্দে।

💔

পাঠকের উদ্দেশ্যে

প্রিয় পাঠক,
এই গল্পের প্রতিটি মুহূর্তে তোমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ। এটি শুধু একটি হারানো ভালোবাসার গল্প নয়, বরং জীবনের বাস্তবতা, আত্মত্যাগ ও সমাজের বাধার গল্প। প্রেম কখনো কখনো স্পষ্ট না হলেও, তার অনুভূতি চিরকাল অমলিন থাকে। আশা করি এই গল্প তোমার হৃদয়ে ছোট্ট কোনো আলোর ঝলক ছড়িয়েছে। তুমি যদি ভালোবেসো, যদি অনুভব করো—তাহলে এই গল্প শেয়ার করতে ভুলোনা। ভালোবাসা ছড়ানোর মতোই একটি শক্তি।

তোমার ভালোবাসা এবং সমর্থনেই এই ধরনের গল্পগুলো জীবন্ত থাকে। ধন্যবাদ আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য।


Previous Post Next Post
Love Poems
Health Tips
Food & Recipes
Read Books
Job Circulars
Loading...
Loading...
Loading...
Loading...
Loading...