বাংলাদেশের শপিং মল ও রেস্টুরেন্টে ৫% ভ্যাটের নামে সাধারণ মানুষ কীভাবে প্রতিদিন ঠকছে, তা নিয়ে রচিত হয়েছে এই ব্যঙ্গাত্মক রম্যগল্প "ভ্যাটু মামার ভোজনবিলাস"।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ভ্যাটু মিয়া একাধারে সচেতনতা-সৃষ্টিকারী, আবার তীব্র রসবোধসম্পন্ন এক প্রতিবাদী কণ্ঠ। প্যান্ট কেনা থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্টে পানি খাওয়া পর্যন্ত—সবখানেই ভ্যাট কীভাবে সাধারণ জনগণের পকেট কেটে নিচ্ছে, তা তুলে ধরা হয়েছে হাস্যরসের মোড়কে। গল্পটি পাঠকদের সচেতন করে তোলে, প্রশ্ন করতে শেখায়—আমরা যে কর দিচ্ছি, তার সঠিক ব্যবহার কোথায়? এটি শুধুই হাসির গল্প নয়, বরং একটি সামাজিক প্রতিবাদ, যা বিনোদনের ছলে তীব্র বার্তা দেয়। যারা সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে চিন্তা করেন, তাদের জন্য এই গল্প একদম উপযুক্ত।
ঢাকা শহরের এক গলির মোড়ে বসে থাকা চায়ের দোকানে হঠাৎ একদিন একজন প্যাঁচানো গোঁফওয়ালা ভদ্রলোকের আবির্ভাব ঘটল। মাথায় টুপি, হাতে লাঠি, চোখে চশমা—একেবারে কেতাদুরস্ত। সবাই ভাবল, উনি বুঝি কাবুলিওয়ালা নন, বরং ভ্যাটিওয়ালা! তবে নাম জানার পর সবাই হতবাক—নাম "ভ্যাটু মিয়া"।
ভ্যাটু মিয়া বস্তুত একজন সুশিক্ষিত প্রতারক। না না, সেই খারাপ অর্থে না। তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন জনগণকে ভ্যাট সম্পর্কে সচেতন করতে, ঠিক সেইভাবে যেমন কেউ কেউ টিকটকে মানুষকে ফেইসিয়াল ও পাউডার সম্পর্কে সচেতন করেন।
একদিন ভ্যাটু মিয়া ঘুরে ঘুরে পল্টনের এক বড় শপিং মলে ঢুকলেন। ভেতরে ঢুকে তিনি একটাই জিনিস খুঁজলেন—“ভ্যাট কোথায় লুকায়?”
প্যাঁচাল প্যাচাল ভ্যাটের কাহিনী :
“ভাই, এই প্যান্টটা কত?” — তিনি এক সেলসম্যানকে জিজ্ঞাসা করলেন।
“স্যার, ১২৫০ টাকা। সাথে ভ্যাট।”
“ভ্যাট মানে? কত?”
“স্যার, মাত্র ৫ শতাংশ।”
“মানে... ৬২.৫ টাকা? ভাইরে ভাই, আমি কি ঘরে বসে সরকারের শুল্ক পরিশোধ করতেছি নাকি? জাস্ট একটা প্যান্ট! প্যান্টে ৫% ভ্যাট, অথচ সরকারি হাসপাতালে স্যালাইন ফ্রি নাই?”
লোকজন হাঁ করে তাকায়।
তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, “ভাইসব! আপনাদের মনে কষ্ট লাগলেও, আমার হৃদয়ে চুলকানি লাগতেছে। আমি জানি, আপনি শপিং করছেন। কিন্তু আপনি জানেন কি, আপনি একটা জামা কিনে গোপনে দেশের বাজেট পূরণে অবদান রাখতেছেন? এবং সেই বাজেট দিয়ে কিনা এমপি সাহেব মালদ্বীপ ভ্রমণ করেন।”
রেস্টুরেন্টের রসমালাই ও ভ্যাটের ভাই :
শপিং শেষে ভ্যাটু মিয়া গেলেন রেস্টুরেন্টে। মেন্যু হাতে নিয়ে চোখ কুঁচকে দেখলেন—
“চিকেন বিরিয়ানি — ৩৫০ টাকা (ভ্যাটসহ ৩৬৭.৫০)”
“ফিরনি — ৮০ টাকা (ভ্যাটসহ ৮৪)”
“পানি — ২০ টাকা (ভ্যাটসহ ২১)”
তিনি ওয়েটারকে ডেকে বললেন, “ভাই, এই পানি কি ফিল্টার করে আপনি স্বর্গ থেকে আনছেন? নাকি আটলান্টিক মহাসাগর থেকে?”
ওয়েটার কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “স্যার, নিয়ম আছে... ভ্যাট তো দিতে হয়।”
ভ্যাটু মিয়া তখন চেয়ার টেনে উঠলেন। “ভাইসব! আজ আমরা এমন এক রেস্টুরেন্টে খাচ্ছি, যেখানে পানি খেলেও সরকার খুশি হয়। আপনি পানি খাবেন, সরকার হাঁসবে! আপনি রসমালাই খাবেন, সরকার কর জমাবে! এইভাবে যদি চলতে থাকে, একদিন মায়ের হাতের রান্নার উপরেও হয়তো ভ্যাট বসবে!”
প্রতারণার মধুর ছুরি :
মল থেকে বের হয়ে ভ্যাটু মিয়া গুলিস্তান মোড়ে একখানা মাইক্রোফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। সঙ্গে ছিল তার নিজস্ব ব্যানার—“ভ্যাট মানে, জনগণের ঝাঁটাপেটা”।
লোকজন জড়ো হলো।
“ভাইসব! আজ আমরা এমন এক দেশে বাস করি, যেখানে আপনি প্রেম করলে না হয় প্রেমে প্রতারণা হবে, কিন্তু খাবার কিনে যদি প্রতারিত হন, সেটা তো চরম নিষ্ঠুরতা!
আপনি ভাবছেন আপনি ‘কম্বো মিল’ খেয়েছেন ৪৯৯ টাকায়। কিন্তু কাশ্মীরি কাওয়াবের সাথে আপনি ২৪.৯৫ টাকা সরকারকে দান করেছেন—জেনে না জেনে। এটা কী জনগণের সঙ্গে হিউমার না হিউমিলিয়েশন?”
এক বৃদ্ধ লোক ফিসফিস করে বলল, “বাবা, এইটা কি হুমায়ূন আহমেদ লিখতেছে না লাইভে বক্তৃতা দিচ্ছে?”
ভ্যাটু মিয়া হেসে বললেন, “না চাচা, আমি জনগণের জন্য বিটিভি না, আমি জনগণের জন্য ভ্যাট-টিভি!”
নোটিশের আক্রমণ :
একদিন হঠাৎ করেই শোনা গেল—ভ্যাটু মিয়াকে রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশন নোটিশ দিয়েছে। অভিযোগ—তিনি ভ্যাটের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছেন। অথচ সবাই জানে, উনি শুধু সত্যটাকে একটু হাসির চাদর দিয়ে মুড়িয়ে দেন।
তিনি আদালতে গেলেন। বিচারক বললেন, “আপনি কেন জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন?”
ভ্যাটু মিয়া চুপ করে একটি রসিদ বের করলেন:
চিকেন রোল: ১০০ টাকা
কোক: ৫০ টাকা
ভ্যাট: ৭.৫ টাকা
সার্ভিস চার্জ: ১৫ টাকা
VAT on Service: ০.৭৫ টাকা
মোট: ১৭৩.২৫
“স্যার, আমি বিভ্রান্ত হই নাই, আমাকে বিভ্রান্ত করা হইছে। আপনি বলেন, আমি কোক খেয়েছি ৫০ টাকায়, কিভাবে সেটা ৬৫ টাকায় পৌঁছায়? কোক খেয়ে আমি কি এনার্জি পেলাম, নাকি বিদ্যুৎ বিল দিয়ে ফেললাম?”
বিচারক হেসে ফেললেন।
ভ্যাট-ক্রান্তি :
এরপর দিন হঠাৎ দেখা গেল ঢাকার প্রতিটি রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, শপিং মল-এর সামনে লাইন পড়ে গেছে। সবাই দাবী করছে—“ভ্যাটু মামার সত্য বলো, চা খেতে ভ্যাট ফেলো!”
চায়ের দোকানে ব্যানার: “ভ্যাট ছাড়াই চা — জনগণের প্রিয়”
এক তরুণ কবি স্ট্যাটাস দিল—
“পোলোভাতে ভ্যাট নেই,
কিন্তু কফিতে আছে —
এইটা কি জনগণের ভাগ্য,
নাকি সরকারের তামাশা?”
সরকার নড়েচড়ে বসলো।
তারা বললো, “আমরা VAT কমাবো, তবে VATU কমানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। উনি এখন জাতির মনজুড়ে বাস করেন।”
পানিতে ভ্যাট আর চোখে জল :
একদিন হঠাৎ দেখা গেল ভ্যাটু মিয়া একটা খোলা মাঠে বসে আছেন। চারপাশে হাজারো মানুষ। এক শিশু এসে বলল, “চাচা, আমি একটা চকলেট খেয়েছিলাম, ১০ টাকার। দোকানদার বললো, ভ্যাট দিতে হবে ৫০ পয়সা। আমি বললাম, ওটা আমার টিফিনের টাকাও না। আপনি কি পারবেন এটা বন্ধ করতে?”
ভ্যাটু মিয়া শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “আমি না পারলেও একদিন তুমি পারবে। কারণ তোমার হাতে ভ্যাটের বিল থাকবে না, থাকবে মানুষের অধিকার।”
সবাই কেঁদে ফেললো। কেউ হেসে, কেউ চুপচাপ—কিন্তু কারো চোখে ভ্যাট ছিল না, ছিল শুধুই জল।
এই গল্প কোনো চরিত্র বা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে লেখা নয়, বরং একটি নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরার প্রচেষ্টা। যেখানে ভ্যাট একসময় এমন এক চোরাগলি হয়ে উঠেছে, যা দিয়ে নাগরিকদের পকেট কেটে নেয়া হয় প্রতিটি নিঃশ্বাসে। প্রতিবাদ করুন, কিন্তু হেসে হেসে—কারণ তবেই সেই প্রতিবাদ সবার কানে পৌঁছায়।
📢 পাঠকের উদ্দেশ্যে কিছু কথা:
প্রিয় পাঠক,
"ভ্যাটু মামার ভোজনবিলাস" নিছক একটি হাস্যরসের গল্প নয়। এটি আমাদের চারপাশের বাস্তবতাকে একটু রঙ্গরসে মাখিয়ে আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা। শপিং মল হোক বা রেস্টুরেন্ট, এমনকি বোতল পানি বা ফিরনিতেও যদি ভ্যাট বসে, তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে—এই ভ্যাট কি জনগণের উন্নয়নে কাজে লাগছে, নাকি কেবলই টাকায় টাকায় লোপাটের পায়তারা?
এই গল্পের উদ্দেশ্য কাউকে অপমান করা নয়, বরং চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া—আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, আর কতটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি এই অন্যায় ‘বৈধ ডাকাতি’ মেনে নিতে।
আপনি হাসলেন, ভালো লাগলো—এটাই চেয়েছি।
তবে এক ফাঁকে যদি একটু ভেবে বসেন, "আমি যা দিচ্ছি, তার সঠিক ব্যবহার কি হচ্ছে?"—তাহলেই এই গল্প সফল।
পরেরবার যখন পানির বোতলে ভ্যাট দেখে বিরক্ত হবেন, মনে রাখবেন—
ভ্যাট শুধু একটা কর নয়, এটি একটি প্রশ্ন: “আপনার টাকায় চলছে কার উন্নয়ন?”
চলুন, হাসতে হাসতে প্রতিবাদ করি। কারণ নিঃশব্দ হাসি একদিন গর্জে উঠবে গণসচেতনতায়।
ভালো থাকুন, ভ্যাট-সচেতন থাকুন।
আপনার
হাস্যরসের সঙ্গী
✍️
আজকের প্রশ্ন:
🧐 "আপনি আজ যা কিনেছেন—তা কি শুধুই পণ্য, নাকি তার সঙ্গে নিঃশব্দে কেউ আপনার পকেটও কেটেছে?"
ভেবে দেখুন—একটা বোতল পানিতে ৫% ভ্যাট!
এই ভ্যাট কোথায় যায়, কে খায়, কে দায় নেয়?
আপনার হাসিমাখা দিন হোক, কিন্তু প্রশ্নমুখরও হোক।
Tags:
Analysis Content