সামাজিক বৈষম্যের দেয়াল ভাঙার আহ্বান: এক প্রতিবাদী আলোকপাত

আমাদের সমাজ বহুস্তরীয় বৈষম্যের জালে আবদ্ধ। প্রতিদিন আমরা এমন অসংখ্য ঘটনা প্রত্যক্ষ করি, যেখানে মানুষ কেবল তাদের লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, পেশা, বা শারীরিক অবস্থার কারণে বৈষম্যের শিকার হয়। এই বৈষম্য কেবল ব্যক্তিগত কষ্টই নয়, বরং একটি সুস্থ, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনেও বড় বাধা। কাল্পকথা৩৬০ ব্লগের পক্ষ থেকে আজ আমরা সমাজের গভীরে প্রোথিত এই বৈষম্যগুলো নিয়ে এক প্রতিবাদী আলোচনা তুলে ধরব, যা আপনাদের চিন্তাভাবনাকে আলোড়িত করবে এবং একটি সমতাপূর্ণ সমাজ গড়ার আন্দোলনে শরিক হতে অনুপ্রাণিত করবে।

নারী বনাম পুরুষের মজুরি ও নিরাপত্তা বৈষম্য: নীরব কান্না

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য এক দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি। কর্মক্ষেত্রে এই বৈষম্য সবচেয়ে প্রকট। একই কাজ করেও নারীরা প্রায়শই পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পান। এটি কেবল আর্থিক বৈষম্য নয়, নারীর শ্রম ও মেধার প্রতি এক ধরনের অবমূল্যায়ন। তৈরি পোশাক শিল্প, যেখানে নারী শ্রমিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা, সেখানেও এই বৈষম্য চোখে পড়ার মতো। উদাহরণস্বরূপ, একজন পুরুষ পোশাক শ্রমিক যে কাজের জন্য $১০০ পায়, সেই একই কাজের জন্য একজন নারী শ্রমিক $৮০ পেতে পারে, যদিও তাদের উৎপাদনশীলতা সমান। এই ধরনের মজুরি বৈষম্য নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে বাধাগ্রস্ত করে এবং তাদের সামাজিক অবস্থানকে দুর্বল করে তোলে।

মজুরি বৈষম্যের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা একটি বড় প্রশ্ন। কর্মস্থলে হয়রানি, যৌন নিপীড়ন এবং সহিংসতা নারীর জন্য এক ভয়াবহ বাস্তবতা। অনেক নারী ভয়ে তাদের অভিযোগ জানাতেও দ্বিধা করেন, কারণ তারা আশঙ্কা করেন যে এতে তাদের চাকরি হারাতে হতে পারে বা আরও খারাপ পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন। গণপরিবহনে নারীদের হয়রানি একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কর্মজীবী নারীরা প্রায়শই সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে নানা ধরনের বঞ্চনা এবং হয়রানির শিকার হন, যা তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই নিরাপত্তাহীনতা নারীর কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণকে সীমিত করে এবং তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে খর্ব করে। সমাজের এই নীরব কান্না শুনতে হবে এবং এর প্রতিকারের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নিয়োগকর্তাদের উচিত নারীর জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এবং হয়রানিকারী ও নিপীড়কদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

হিজড়া জনগোষ্ঠী বা তৃতীয় লিঙ্গের সামাজিক অবহেলা: অস্তিত্বের সংকট

হিজড়া জনগোষ্ঠী, বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত এবং বৈষম্যের শিকার। তাদের জন্মগত ভিন্নতার কারণে তারা সমাজ, পরিবার, এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। শৈশব থেকেই তারা পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। স্কুল-কলেজে তাদের ভর্তি হতে দেওয়া হয় না, এমনকি চিকিৎসা সেবা পেতেও তাদের নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়। ফলে তাদের মৌলিক মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়। অনেক সময় তাদের উপার্জনের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি বা দেহ ব্যবসার মতো পথ বেছে নিতে বাধ্য করা হয়, যা তাদের সামাজিক মর্যাদা আরও ক্ষুণ্ণ করে।

এই বৈষম্য কেবল সামাজিক নয়, মানসিকও। সমাজে তাদের প্রতি যে ঘৃণা ও অবজ্ঞা প্রদর্শিত হয়, তা তাদের আত্মসম্মানবোধকে চরমভাবে আঘাত করে। তারা প্রায়শই মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ, এবং একাকীত্বের শিকার হন। তাদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা জরুরি। সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর উচিত হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা। তাদের সমাজে স্বাভাবিক জীবনযাপনে সহায়তা করার জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং তাদের প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য।

আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বঞ্চনা: হারানো ঐতিহ্য

আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, ভাষা, এবং জীবনযাত্রার কারণে প্রায়শই সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের বৈষম্যের শিকার হয়। তাদের জমি ও সম্পত্তির অধিকার নিয়ে বিরোধ, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চনা, এবং সাংস্কৃতিক অবহেলা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে ভূমি বিরোধ এবং জাতিগত সহিংসতার শিকার। তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবনযাপন পদ্ধতি এবং সংস্কৃতি প্রায়শই হুমকির মুখে পড়ে।

শিক্ষাক্ষেত্রেও আদিবাসী শিশুরা বৈষম্যের শিকার হয়। তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগের অভাব এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতার অভাব তাদের পড়াশোনায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। ফলস্বরূপ, তারা মূলধারার সমাজ থেকে পিছিয়ে পড়ে। গণমাধ্যমে এবং শিক্ষাব্যবস্থায় আদিবাসী সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুল উপস্থাপনা তাদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। সরকারের উচিত আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষা করা, তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে সহায়তা করা, এবং তাদের জন্য বিশেষ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা। তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং তাদের নিজস্ব জীবনধারা বজায় রাখার অধিকারকে সম্মান জানানো উচিত।

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সামাজিকভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ: ভয়ের ছায়া

ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা প্রায়শই সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের দ্বারা বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন। এই বৈষম্য রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিস্তৃত। ধর্মীয় কারণে তাদের সম্পত্তি দখল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, এবং সামাজিক বর্জন বাংলাদেশের মতো বহু ধর্মীয় সমাজে একটি গুরুতর সমস্যা। পূজার সময় বা নির্বাচনের আগে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ এবং তাদের বাড়িঘরে ভাঙচুর একটি পুনরাবৃত্ত ঘটনা।

শিক্ষাক্ষেত্রে এবং কর্মসংস্থানেও তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বা পদোন্নতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয় একটি অদৃশ্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই ধরনের বৈষম্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা এবং বয়ের জন্ম দেয়। তারা নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করতে শুরু করে। রাষ্ট্রের উচিত সকল নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ করা। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বাড়ানোর জন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত।

শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের সুযোগ-সুবিধায় বৈষম্য: অদৃশ্য দেয়াল

শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীরা আমাদের সমাজের সবচেয়ে বঞ্চিত অংশ। তাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সুযোগ-সুবিধার অভাব তাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে। গণপরিবহন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল, এবং সরকারি ভবনে প্রবেশগম্যতার অভাব তাদের চলাফেরায় বাধা সৃষ্টি করে। হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য র‍্যাম্পের অভাব, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল সাইনেজের অভাব, এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য দোভাষীর অভাব তাদের দৈনন্দিন জীবনকে চ্যালেঞ্জিং করে তোলে।

শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। মূলধারার স্কুলগুলোতে তাদের ভর্তি করা হয় না বা তাদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও তাদের প্রতি বৈষম্য করা হয়। অনেক নিয়োগকর্তা তাদের শারীরিক বা মানসিক অবস্থার কারণে তাদের নিয়োগ দিতে চান না, এমনকি যদি তারা কাজটি করার জন্য সম্পূর্ণরূপে সক্ষম হন। এই ধরনের বৈষম্য তাদের আত্মবিশ্বাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং তাদের সমাজে অবদান রাখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। সমাজের উচিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া এবং তাদের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা। সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর উচিত তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, এবং চলাফেরার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

শহরের বস্তিবাসী বনাম ফ্ল্যাটবাসীদের নাগরিক সুবিধা: এক বিভেদ রেখা

শহরের বস্তিবাসী এবং ফ্ল্যাটবাসীদের মধ্যে নাগরিক সুবিধার ক্ষেত্রে এক বিরাট বৈষম্য বিদ্যমান। বস্তি এলাকায় মৌলিক সুবিধা যেমন বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ, এবং স্বাস্থ্য সেবার তীব্র অভাব রয়েছে। তাদের বাসস্থান প্রায়শই অস্বাস্থ্যকর এবং ঘিঞ্জি হয়, যা বিভিন্ন রোগের বিস্তার ঘটায়। অন্যদিকে, ফ্ল্যাটবাসীরা সকল আধুনিক নাগরিক সুবিধা উপভোগ করেন।

এই বৈষম্য কেবল ভৌত সুবিধা নয়, সামাজিক মর্যাদাতেও প্রতিফলিত হয়। বস্তিবাসীদের প্রায়শই সমাজের নিম্ন শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দেখা হয় এবং তাদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়। তাদের শিশুরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগও সীমিত। এই বৈষম্য বস্তিবাসীদের জীবনমানকে নিম্নমুখী করে তোলে এবং তাদের দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে বাধা দেয়। সরকারের উচিত বস্তিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা, তাদের মৌলিক নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা, এবং তাদের জন্য উন্নত বাসস্থানের ব্যবস্থা করা।

গৃহকর্মীর প্রতি মালিকদের অবহেলা ও অমানবিকতা: অদৃশ্য শোষণ

গৃহকর্মীরা প্রায়শই মালিকদের অবহেলা ও অমানবিকতার শিকার হন। তাদের কাজের নির্দিষ্ট সময় থাকে না, সাপ্তাহিক ছুটির অভাব, এবং ন্যূনতম মজুরির অভাব একটি সাধারণ চিত্র। অনেক সময় তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তাদের প্রতি মালিকদের আচরণ অমানবিক এবং নিষ্ঠুর হতে পারে।

গৃহকর্মীরা প্রায়শই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হন এবং তাদের নিজস্ব কোনো সামাজিক সুরক্ষা জাল থাকে না। আইনি সুরক্ষার অভাব তাদের অবস্থানকে আরও দুর্বল করে তোলে। সরকার এবং সমাজের উচিত গৃহকর্মীদের অধিকার রক্ষা করা এবং তাদের জন্য আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাদের কাজের সময়, মজুরি, এবং ছুটির বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট নীতি থাকা উচিত। গৃহকর্মীদের প্রতি সংবেদনশীলতা বাড়ানোর জন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

পেশাভিত্তিক বৈষম্য (ঝাড়ুদার, রিকশাচালক, জেলেরা অবমূল্যায়িত): শ্রমের অমর্যাদা

আমাদের সমাজে কিছু পেশার মানুষকে অবজ্ঞা করা হয়, যা এক ধরনের পেশাভিত্তিক বৈষম্য। ঝাড়ুদার, রিকশাচালক, জেলে, এবং অন্যান্য কায়িক শ্রমিকের কাজকে প্রায়শই নিম্নমানের এবং অবহেলিত মনে করা হয়। তাদের শ্রমের মূল্য দেওয়া হয় না এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা খুব কম।

এই পেশার মানুষরা প্রায়শই স্বল্প মজুরি পান এবং তাদের কাজের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একজন ঝাড়ুদার শহরের আবর্জনা পরিষ্কার করে আমাদের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখেন, কিন্তু তাদের সম্মান এবং স্বীকৃতি খুব কম। রিকশাচালকরা কঠোর পরিশ্রম করে আমাদের যাতায়াতের সুবিধা দেন, কিন্তু তাদের আয় অনিশ্চিত এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রায়শই অবহেলিত। এই ধরনের বৈষম্য শ্রমের অবমূল্যায়ন করে এবং শ্রমজীবী মানুষের আত্মসম্মানবোধকে ক্ষুণ্ণ করে। সমাজের উচিত সকল পেশার মানুষকে সম্মান জানানো এবং তাদের শ্রমকে মূল্য দেওয়া। তাদের কাজের পরিবেশ উন্নত করা এবং তাদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

পুলিশ ও রাজনীতিবিদদের সন্তান বনাম সাধারণ মানুষের সন্তানের সাথে আচরণে ফারাক: ক্ষমতার অপব্যবহার

পুলিশ এবং রাজনীতিবিদদের সন্তানদের সাথে সাধারণ মানুষের সন্তানদের আচরণের ক্ষেত্রে এক বিশাল ফারাক বিদ্যমান। ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের সন্তানরা প্রায়শই বিশেষ সুবিধা এবং ছাড় উপভোগ করেন, যা সাধারণ মানুষের সন্তানদের জন্য প্রযোজ্য নয়। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও এই বৈষম্য দেখা যায়। প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যরা অপরাধ করেও অনেক সময় পার পেয়ে যান, যেখানে সাধারণ মানুষ সামান্য অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির শিকার হন।

শিক্ষাক্ষেত্রে, চাকরিতে নিয়োগে, এবং অন্যান্য সামাজিক সুযোগ-সুবিধায় এই বৈষম্য স্পষ্ট। এই ধরনের বৈষম্য সমাজে অন্যায় এবং অবিচারের জন্ম দেয়। এটি আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে ক্ষুণ্ণ করে। রাষ্ট্র এবং সমাজের উচিত এই ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার এবং সুযোগ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

নামের আগে "ডা.", "ইঞ্জি.", "ব্যারিস্টার", "মাস্টার" যুক্ত থাকলে সম্মান বেশি: এক কৃত্রিম বিভাজন

আমাদের সমাজে নামের আগে "ডা.", "ইঞ্জি.", "ব্যারিস্টার", "মাস্টার" ইত্যাদি উপাধি যুক্ত থাকলে সেই ব্যক্তিকে বেশি সম্মান করা হয়। এটি এক ধরনের কৃত্রিম সামাজিক বিভাজন তৈরি করে। এই উপাধিগুলো পেশাগত যোগ্যতা নির্দেশ করে, কিন্তু এর কারণে একজন মানুষকে অন্য পেশার মানুষের চেয়ে বেশি সম্মান করা উচিত নয়।

শিক্ষিত এবং উচ্চ পেশার মানুষের প্রতি অতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শন এবং অন্যান্য পেশার মানুষের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন একটি ভুল প্রবণতা। সমাজে সকল পেশার মানুষের অবদানকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা উচিত। একজন কৃষক, একজন শ্রমিক, একজন শিক্ষক, এবং একজন চিকিৎসক – সকলেই সমাজের জন্য অপরিহার্য। এই ধরনের বৈষম্য দূর করে একটি সমতাপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলার জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা প্রয়োজন।

বৈষম্যহীন সমাজের পথে: আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব

উপরে উল্লিখিত প্রতিটি বৈষম্যই আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এই বৈষম্যগুলো কেবল কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জীবনকেই প্রভাবিত করে না, বরং সামগ্রিকভাবে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সমতাপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিটি ব্যক্তি, সম্প্রদায়, এবং রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এই বৈষম্যের দেয়াল ভাঙা সম্ভব।

আমাদের এই প্রতিবাদী গবেষণা প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের প্রতিটি স্তরে বিদ্যমান বৈষম্যকে চিহ্নিত করা এবং এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা। আমরা বিশ্বাস করি, কেবলমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আলোচনার মাধ্যমেই আমরা একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারি। আসুন, আমরা সকলে মিলে এমন একটি সমাজ গড়ি যেখানে কেউ তাদের লিঙ্গ, ধর্ম, জাতি, পেশা, বা শারীরিক অবস্থার কারণে বৈষম্যের শিকার হবে না। যেখানে প্রতিটি মানুষ সমান মর্যাদা এবং সুযোগ নিয়ে বাঁচতে পারবে।

আমাদের ব্যক্তিগত আচরণ, পারিবারিক শিক্ষা, এবং সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ছাড়া এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সমাজের সকল স্তরের মানুষকে সমান চোখে দেখতে হবে এবং প্রতিটি মানুষের অধিকারকে সম্মান জানাতে হবে।

আমরা আশা করি, এই প্রবন্ধটি আপনাদের মধ্যে গভীর চিন্তাভাবনার জন্ম দেবে এবং আপনারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই বৈষম্য দূরীকরণে ভূমিকা রাখবেন। কল্পকথা৩৬০ ব্লগের পক্ষ থেকে আমরা সর্বদা সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে আওয়াজ তুলব।
বাংলাদেশে সামাজিক বৈষম্য | লিঙ্গ, শ্রেণি, পেশা ও পরিচয়ে বৈষম্যের বাস্তব চিত্র
Previous Post Next Post
Love Poems
Health Tips
Food & Recipes
Read Books
Job Circulars
Loading...
Loading...
Loading...
Loading...
Loading...