বৈষম্যের বেড়াজালে বাংলাদেশ: ক্ষমতা, দুর্নীতি ও জনদুর্ভোগের এক বিশ্লেষণ

ভূমিকা: বৈষম্যমূলক শাসনের গভীরে

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্যের পরিচিতি

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রশংসনীয় হলেও, দেশটি গভীর শাসনতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এখানে দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক রাজনৈতিকীকরণ এবং জবাবদিহিতার পদ্ধতিগত অভাব প্রকট। এই বিষাক্ত সংমিশ্রণ ব্যাপক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য তৈরি করেছে, যা ক্রমাগত জনআস্থা ক্ষুণ্ন করছে এবং গণতান্ত্রিক নীতির মূল ভিত্তিকেই দুর্বল করে দিচ্ছে । দেশের শাসনব্যবস্থা দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঔপনিবেশিক আমলের পুরনো আইন এবং "মালিক-সেবক" মানসিকতার সঙ্গে আটকে আছে, যা আধুনিক যুগের জটিল চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। এই অচল অবস্থা স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং ন্যায়সঙ্গত জনসেবা প্রদানে গুরুতর সমস্যা তৈরি করছে ।   

এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশে বিদ্যমান বৈষম্যের নির্দিষ্ট দিকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতে চায়। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার অখণ্ডতা, বিচারিক কার্যক্রমের নিরপেক্ষতা, ভিআইপি প্রোটোকলের কারণে সৃষ্ট জনদুর্ভোগ, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর পদ্ধতিগত হয়রানি এবং প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণ। "কল্পকথা-৩৬০" ব্লগের সামাজিক সচেতন পাঠকদের জন্য এটি একটি গবেষণামূলক, সমালোচনামূলক এবং প্রতিবাদী বিশ্লেষণ উপস্থাপন করবে।

বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা, বিশেষ করে দুর্নীতির ব্যাপকতা, একটি সুস্পষ্ট বৈপরীত্য তৈরি করে। এই পরিস্থিতিকে "বাংলাদেশ প্যারাডক্স" হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কীভাবে একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করতে পারে, যখন তার মূল শাসনতান্ত্রিক কাঠামো পদ্ধতিগত ব্যর্থতায় জর্জরিত? এই উন্নয়নকে প্রায়শই "একপেশে উন্নয়ন" হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যা অগ্রগতির "অপ্রীতিকর এবং অপ্রশংসনীয় দিক" গোপন করে। এটি "অতি ধনীদের" দ্রুত বৃদ্ধি এবং একই সাথে "দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়া" মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করে। এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়, বরং এটি একটি নির্বাচিত গোষ্ঠীর সুবিধা নিশ্চিত করে। সম্পদ এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার এই কেন্দ্রীভবন দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক প্রভাবের সাথে সরাসরি যুক্ত। ক্ষমতাশালীরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে সম্পদ বৃদ্ধি করে, এবং এই সম্পদ বৃদ্ধি আবার দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করে, যা একটি দুষ্টচক্রের জন্ম দেয়। এই "বাংলাদেশ প্যারাডক্স" কেবল একটি একাডেমিক কৌতূহল নয়, বরং এটি একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক কৌশল। চিত্তাকর্ষক অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান তুলে ধরে সরকার তার শাসনতান্ত্রিক ব্যর্থতা এবং মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারে। এটি অগ্রগতির একটি মুখোশ তৈরি করে, যা গভীর সামাজিক বৈষম্য এবং অবিচারকে আড়াল করে রাখে, ফলে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের জন্য নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির পক্ষে চাপ সৃষ্টি করা কঠিন হয়ে পড়ে।

১. সরকারি চাকরিতে নিয়োগে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব

নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ

বাংলাদেশে সরকারি দপ্তরগুলোতে দুর্নীতি ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, যা ধারাবাহিকভাবে দেশকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় স্থান করে দিয়েছে। এই স্থানীয় দুর্নীতি সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ ও পদায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক রাজনৈতিকীকরণ, পক্ষপাতিত্ব এবং স্বজনপ্রীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত, যা সুশাসনের পথে এক বিশাল বাধা । জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, "প্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণ" মেধা ও দক্ষতার গুরুত্বকে মারাত্মকভাবে হ্রাস করেছে। এর পরিবর্তে, নিয়োগ, পদায়ন এবং পদোন্নতি প্রায়শই "যোগ্যতার পরিবর্তে রাজনৈতিক আনুগত্য এবং তোষামোদ" দ্বারা নির্ধারিত হয়। এই পদ্ধতিগত ত্রুটি অনেক কর্মকর্তাকে অন্যায়ভাবে পদোন্নতি ও সুবিধা পেতে সাহায্য করেছে, কার্যকরভাবে তাদের "স্বৈরাচারী শাসনের সহায়ক" হিসেবে রূপান্তরিত করেছে ।   

ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদ, আমলা এবং ব্যবসায়ী অভিজাতদের মধ্যে একটি শক্তিশালী "লৌহ ত্রিভুজ" (iron triangle) বিদ্যমান, যা সুশাসনকে উন্নত করতে পারে এমন যেকোনো অর্থপূর্ণ সংস্কারকে সক্রিয়ভাবে বাধা দেয়। এই গোষ্ঠীগুলো বর্তমান দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা থেকে সরাসরি লাভবান হয়, ফলে তারা স্থিতাবস্থার কট্টর রক্ষক হিসেবে কাজ করে । প্রশাসনের প্রতি জন অসন্তোষ ব্যাপক ও গভীর। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৮০% উত্তরদাতা মনে করেন প্রশাসন জনবান্ধব নয়, আর ৬৬% মনে করেন সরকারি কর্মচারীরা জনগণের সেবক না হয়ে "শাসকের" মতো আচরণ করেন ।   

নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিকীকরণ মেধাতন্ত্রের জন্য একটি বড় আঘাত। গবেষণাগুলো স্পষ্টভাবে দেখায় যে, সরকারি নিয়োগ ও পদোন্নতিতে মেধা ও দক্ষতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য এবং তোষামোদকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এটি সরাসরি মেধাতন্ত্রের নীতিকে দুর্বল করে, যা কার্যকর জনসেবার জন্য অপরিহার্য। এই সমস্যাটি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপক প্রচলন এবং উচ্চ-পর্যায়ের নিয়োগে নথিভুক্ত অনিয়ম দ্বারা আরও তীব্র হয়। এই ঘটনাগুলো একটি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থাকে পদ্ধতিগতভাবে ব্যাহত করার প্রমাণ দেয়। ক্ষমতা সংহত করা, পৃষ্ঠপোষকতা নেটওয়ার্ক তৈরি করা এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্য নিশ্চিত করাই এই অনুশীলনের মূল উদ্দেশ্য। এই ব্যবস্থা ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের তাদের মিত্রদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে দেয়, তাদের যোগ্যতা নির্বিশেষে। এর তাৎক্ষণিক পরিণতি হলো একটি অদক্ষ ও জবাবদিহিতাহীন আমলাতন্ত্র যা জনগণের সেবার পরিবর্তে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের প্রতি অনুগত। এর ফলে যোগ্য ও মেধাবী নাগরিকদের মধ্যে গভীর অবিচারের জন্ম হয়, যা সামাজিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে, মেধাবী ব্যক্তিদের বিদেশে চলে যেতে উৎসাহিত করতে পারে এবং সুষ্ঠু সুযোগের সম্ভাবনা সম্পর্কে গভীর cynicism বা নৈরাশ্য তৈরি করতে পারে। সরকারি কর্মচারীদের "শাসক" হিসেবে দেখার জনধারণা এই রাজনৈতিকীকরণ ও অ-মেধাতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি সরাসরি এবং বেদনাদায়ক প্রকাশ।

প্রশ্নপত্র ফাঁস ও মেধার অবমূল্যায়ন

সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা সহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ব্যাপকভাবে রিপোর্ট করা হয়েছে। এই পদ্ধতিগত সমস্যাটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রশাসনিক অনুশীলন থেকে একটি স্পষ্ট বিচ্যুতি নির্দেশ করে, যা সমগ্র নিয়োগ প্রক্রিয়ার অখণ্ডতাকে ক্ষুণ্ন করে । ২০১৪ সাল থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে, যা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি), উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এইচএসসি) এবং এমনকি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাকেও প্রভাবিত করেছে । পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উন্মোচন করেছে: ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অন্তত ৪,০০০ শিক্ষার্থী একটি সংঘবদ্ধ চক্রের কাছ থেকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পেয়ে বিভিন্ন মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়েছে । 'পাবলিক এক্সামিনেশনস (অফেন্সেস) (অ্যামেন্ডেড) অ্যাক্ট, ১৯৯২' এর মতো আইন থাকা সত্ত্বেও, যা পরীক্ষা প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য ৩-১০ বছরের কঠোর কারাদণ্ডের বিধান রাখে, "উদাহরণমূলক শাস্তির" উল্লেখযোগ্য অভাব দেখা গেছে, যা প্রয়োগ ও জবাবদিহিতার গুরুতর ঘাটতি নির্দেশ করে । দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২৯তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২১ জন নন-ক্যাডার মনোনীত ব্যক্তির ক্যাডার পদে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত শুরু করেছে, যেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সম্ভাব্য দুর্নীতির ব্যাপকতা সন্দেহ করা হচ্ছে ।   

কোটা ব্যবস্থার অপব্যবহার

একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায়, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট জুলাই ২০২৪ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কয়েক দিনের মারাত্মক অস্থিরতা ও সংঘর্ষের পর আসে। আদালত নির্দেশ দিয়েছে যে, সরকারি চাকরির ৯৩% নিয়োগ এখন থেকে মেধার ভিত্তিতে হবে, এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটার জন্য ৫% সংরক্ষিত থাকবে, যদিও বিতর্কিত ব্যবস্থাটি পুরোপুরি বাতিল করা হয়নি । এর আগে, সরকারি পদগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য ৫৬% বিভিন্ন কোটার অধীনে সংরক্ষিত ছিল, যার মধ্যে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য, ১০% মহিলাদের জন্য, ১০% সুবিধাবঞ্চিত জেলার জন্য, ৫% ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য এবং ১% প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য। এই ব্যবস্থাটি ২০১৮ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির জন্য বাতিল করা হয়েছিল, যা কোটা সংস্কারের দাবিতে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের ফল ছিল ।   

২. সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে সুবিধাবাদী এলাকা অগ্রাধিকার

রাজনৈতিক সংযোগে প্রকল্প বরাদ্দ

প্রমাণ থেকে বোঝা যায় যে, রাজনৈতিক সংযোগ সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সুবিধা প্রদান করে। রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত সংস্থাগুলো অপ্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে সরকারি চুক্তি পেতে ১৮% থেকে ৩২% বেশি সম্ভাবনা রাখে। এটি সরকারি তহবিল বরাদ্দে একটি পদ্ধতিগত পক্ষপাতিত্বের ইঙ্গিত দেয় । রাজনীতিবিদরা তাদের পদ ব্যবহার করে কেবল সরাসরি আর্থিক লাভের জন্যই নয়, বরং ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা নেটওয়ার্ক তৈরি ও বজায় রাখার জন্যও কাজ করেন, যার মাধ্যমে তারা সরকারি খাতে অযাচিত ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তার করেন। এই গভীর প্রোথিত অনুশীলন দুর্নীতিকে উস্কে দেয়, সরকারি তহবিল ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির জন্য সরিয়ে নেয়, যা বিশেষ করে ব্যাংকিং ও বিদ্যুৎ খাতের মতো লাভজনক ক্ষেত্রগুলোতে স্পষ্ট, এমনকি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও আর্থিক সুবিধা লাভের জন্য প্রভাব বিস্তার করা হয় । সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে একটি "নিলাম সংস্কৃতি"র উদ্ভব হয়েছে, যেখানে শীর্ষ প্রকল্প পরিচালকের পদগুলো মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে (প্রকল্পের বাজেটের ৫% পর্যন্ত) বিক্রি করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। এটি রাজনৈতিক প্রভাব এবং গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্দের মধ্যে সরাসরি ও দুর্নীতিগ্রস্ত সংযোগের এক জীবন্ত উদাহরণ ।   

প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি ও দুর্নীতির জাল

একটি সরকারি টাস্কফোর্স রিপোর্ট থেকে উদ্বেগজনক প্রবণতা উন্মোচিত হয়েছে: আটটি প্রধান মেগা অবকাঠামো প্রকল্পের ব্যয় তাদের প্রাথমিক অনুমানের চেয়ে $৭.৫২ বিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে, যা একটি বিস্ময়কর ৬৮% বৃদ্ধি। এই বিশাল ব্যয়বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে ব্যাপক দুর্নীতি, দুর্বল সম্ভাব্যতা যাচাই, দীর্ঘসূত্রিতা, প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা এবং ব্যাপক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে দায়ী করা হয়েছে । পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, যমুনা রেলওয়ে সেতু, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে এবং বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো উচ্চ-প্রোফাইল প্রকল্পগুলো উল্লেখযোগ্য ব্যয়বৃদ্ধি ও পঙ্গুকারী বিলম্বের সম্মুখীন হয়েছে, যা তাদের সময়মতো সম্পন্ন হওয়া এবং কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করেছে ।   

তদন্তে দেখা গেছে যে, কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্পের বাজেটের ৫০% পর্যন্ত ঘুষ এবং অন্যান্য অনানুষ্ঠানিক ব্যয়ে চলে গেছে। এই বিশাল আর্থিক ক্ষতির পরেও, অস্বাভাবিকভাবে স্ফীত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনার (ডিপিপি) কারণে ঠিকাদাররা প্রচুর মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি সড়ক প্রকল্প যার ব্যয় ৫০ কোটি টাকা হওয়ার কথা, সেটি ১০০-১১০ কোটি টাকা অনুমান করা হয়েছে, যা ঠিকাদারদের ৫০ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার পরেও যথেষ্ট মুনাফা করার সুযোগ করে দিয়েছে । অনেক মেগা প্রকল্প একটি "টপ-ডাউন" পদ্ধতির মাধ্যমে শুরু হয়েছিল, যা মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করেছেন, যা প্রায়শই সুচিন্তিত পরিকল্পনা, কার্যকর সমন্বয় এবং জনস্বার্থের ব্যয়ে হয়েছে । দুর্নীতির এই দীর্ঘ তালিকায় যোগ হয়েছে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রাক্তন পরিচালকের দেশ ছেড়ে পালানোর ঘটনা, যেখানে ৬,৫৭১ কোটি টাকার অমিমাংসিত অডিট আপত্তি রয়েছে, যা জবাবদিহিতার গুরুতর অভাবকে তুলে ধরে ।   

রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের মাধ্যমে প্রকল্প বরাদ্দ এবং এর ফলে সৃষ্ট প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি ও ব্যাপক দুর্নীতি একটি দুষ্টচক্রের জন্ম দেয়। এই দুর্নীতি সরকারি তহবিলের উপর একটি বিশাল বোঝা সৃষ্টি করে, কারণ প্রকল্পের বাজেটের একটি বড় অংশ ঘুষ এবং অবৈধ পেমেন্টের মাধ্যমে সরিয়ে নেওয়া হয়। এর অর্থ হলো প্রকৃত কাজের জন্য কম অর্থ উপলব্ধ থাকে, যার ফলে অবকাঠামোর মান খারাপ হয়, প্রকল্প বিলম্বিত হয় এবং প্রকৃত উন্নয়ন চাহিদা পূরণে মৌলিক ব্যর্থতা দেখা দেয়। "নিলাম সংস্কৃতি" এবং "লৌহ ত্রিভুজ"-এর ব্যাপক প্রভাব প্রমাণ করে যে ক্ষমতাশালী অভিজাতরা এই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা থেকে সরাসরি লাভবান হয়। তাদের স্বার্থান্বেষী মনোভাব সংস্কারের প্রতি একটি শক্তিশালী নিরুৎসাহ তৈরি করে, কারণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দিকে যেকোনো পদক্ষেপ তাদের লাভজনক নেটওয়ার্ককে হুমকির মুখে ফেলবে। সরকারি সম্পদের এই পদ্ধতিগত অপব্যবহার এবং এর ফলে সৃষ্ট অপর্যাপ্ত অবকাঠামো সামগ্রিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে সরাসরি বাধাগ্রস্ত করে। এটি আঞ্চলিক বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে, রাজনৈতিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত এলাকাগুলোতে উন্নয়ন কেন্দ্রীভূত করে, অন্য অঞ্চলগুলোকে অবহেলিত ও অনুন্নত রেখে দেয়। এর পরিণতি হলো একটি দুষ্টচক্র: দুর্নীতি তহবিল সরিয়ে নেয়, যা দুর্বল উন্নয়ন ফলাফলের দিকে নিয়ে যায়, যা আবার আরও প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে, এবং এই প্রকল্পগুলো (প্রায়শই স্ফীত ব্যয়ের) দুর্নীতির আরও সুযোগ তৈরি করে। এইভাবে, আপাত "উন্নয়ন" মূলত অভিজাতদের সমৃদ্ধির একটি প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়, যা প্রকৃত জনকল্যাণের পরিবর্তে কাজ করে, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ায় এবং পদ্ধতিগত অনুন্নয়নকে দীর্ঘস্থায়ী করে।

অসম আঞ্চলিক উন্নয়ন: রাজনৈতিক প্রভাবের ফল

বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রায়শই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চল, শহুরে কেন্দ্র এবং প্রতিষ্ঠিত প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রগুলোতে কেন্দ্রীভূত হয়, যা সারা দেশে স্পষ্ট আঞ্চলিক বৈষম্য তৈরি করে । এই বৈষম্য আকস্মিক নয়; "ক্ষমতাশালী ও সুবক্তা রাজনীতিবিদদের" প্রভাবে নির্দিষ্ট অঞ্চল ও শহুরে এলাকাগুলোতে ধারাবাহিকভাবে উচ্চতর বাজেট বরাদ্দ করা হয়। এই রাজনৈতিক প্রভাব ঐতিহাসিকভাবে এই সুবিধাপ্রাপ্ত এলাকাগুলোতে অন্যদের তুলনায় উন্নত পরিষেবা ও সুবিধা এনে দিয়েছে । সরকার সেতু, সড়ক, বন্দর এবং রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের মতো নতুন অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে আরও ভারসাম্যপূর্ণ আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করলেও, ইতিমধ্যে উন্নত শহুরে কেন্দ্র, বাণিজ্য কেন্দ্র এবং শিল্পাঞ্চলগুলোর অর্থনৈতিক গুরুত্ব—যা উচ্চতর সরকারি ও বেসরকারি উভয় বিনিয়োগ আকর্ষণ করে—এই আঞ্চলিক বৈষম্যকে স্থায়ী ও তীব্র করে তোলে । সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্পষ্টভাবে "অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি" এবং সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির আহ্বান জানানো হয়েছে। এটি অর্জনের জন্য বিদ্যমান অবকাঠামোগত ব্যবধান কমানো, মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রচার এবং পিছিয়ে পড়া ও প্রান্তিক এলাকাগুলোতে স্থানীয় শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী করার ওপর সুচিন্তিতভাবে মনোযোগ দিতে হবে ।   

৩. বিচারিক বৈষম্য: গরিব জেলে ও প্রভাবশালী জামিনে

আইনের প্রয়োগে বৈষম্য ও ন্যায়বিচারের অভাব

বাংলাদেশে আইনের শাসন দুর্বল, যা আইনের বৈষম্যমূলক প্রয়োগ, বিচারিক ত্রুটি এবং দণ্ডিত ব্যক্তিদের জন্য রাষ্ট্রপতির বিতর্কিত ক্ষমা প্রদর্শনের ঘন ঘন ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, যা প্রায়শই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয় । বিচার বিভাগ নিজেই গভীরভাবে রাজনৈতিকীকৃত, যেখানে রাজনৈতিক নিয়োগ, পদোন্নতি এবং এমনকি বরখাস্তও রুটিনমাফিক ঘটনা। এটি এর স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফলে নাগরিকদের জন্য চুক্তি কার্যকর করা বা বিরোধ নিষ্পত্তিতে ন্যায্য বিচার পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। বিচার প্রায়শই সরকার-পন্থী ব্যক্তিদের পক্ষে যায় বলে মনে হয়, যখন ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠ পদ্ধতিগতভাবে দমন করা হয় ।   

একটি উন্নয়নশীল জাতি হিসেবে, বাংলাদেশে সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার মাত্রা কম, যা সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীগুলোর জন্য বিশেষভাবে ভয়াবহ। এর মধ্যে রয়েছে চর ও হাওর অঞ্চলের মানুষ, আদিবাসী সম্প্রদায়, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নারী এবং শিশুরা, যারা আর্থ-সামাজিক ও জন-অবিচারের শিকার হন । সংবিধান তাত্ত্বিকভাবে সকল নাগরিকের আইনের চোখে সমান অধিকার এবং সমান সুরক্ষা পাওয়ার নিশ্চয়তা দিলেও, দরিদ্র ব্যক্তিদের জন্য বাস্তবতা প্রায়শই পুলিশ হেফাজতে বা কারাগারে অসহায়ত্বের, কারণ তারা তাদের অধিকার রক্ষার জন্য আইনি প্রতিনিধিত্বের খরচ বহন করতে পারে না ।   

জামিন ব্যবস্থায় প্রভাবশালীদের সুবিধা

বাংলাদেশে, জামিন আইনত আদালতের দেওয়া একটি বিশেষাধিকার, কোনো অন্তর্নিহিত অধিকার নয়, এবং বিচারকরা তাদের বিবেচনা প্রয়োগ করেন, যদিও তাত্ত্বিকভাবে উচ্চ আদালতের রায় দ্বারা এটি সীমাবদ্ধ। তবে, বাস্তবে, এই বিবেচনা প্রায়শই স্পষ্ট বৈষম্যের দিকে নিয়ে যায়, যেখানে "কুখ্যাত অপরাধীদের" প্রায়শই জামিন দেওয়া হয়, যখন একই সাথে নারী ও শিশুদের মতো দুর্বল গোষ্ঠীগুলোকে জামিন প্রত্যাখ্যান করা হয় । জামিন ব্যবস্থার মধ্যে "দুর্নীতি" ব্যাপকভাবে রিপোর্ট করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে পুলিশের দ্বারা ত্রুটিপূর্ণ প্রাথমিক তথ্য প্রতিবেদন (এফআইআর) বা ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে অনুকূল জামিন ফলাফলের সুবিধা দেওয়া, সরকারি আইনজীবীদের তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করা, এবং বিচারকদের অনভিজ্ঞতা, কাজের চাপ, আন্তরিকতার অভাব, রাজনৈতিক চাপ বা সরাসরি দুর্নীতির কারণে নমনীয়তা দেখানো । সরকার, পুলিশ এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে, জামিনের সিদ্ধান্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে অনুগত অপরাধীদের জন্য অগ্রাধিকারমূলক আচরণ নিশ্চিত করে । নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের ঘটনা একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ: তাকে ২.৩ মিলিয়ন ডলার আত্মসাতের মামলায় এবং একটি পৃথক শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় জামিন দেওয়া হয়েছিল, এমনকি ছয় মাসের কারাদণ্ড হওয়ার পরেও। এটি একই ধরনের অভিযোগের সম্মুখীন সাধারণ নাগরিকদের সংগ্রামের সাথে তীব্র বৈপরীত্য তৈরি করে । আওয়ামী লীগ নিজেই জানিয়েছে যে ইউনূস সরকারের অধীনে মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের করা সমস্ত মামলা "নীরবে বাতিল" করা হয়েছিল, যা ক্ষমতাশালী এবং তাদের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের জন্য সংরক্ষিত অনাক্রম্যতার এক উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে। এর বিপরীতে, পূর্ববর্তী সরকারের সময়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতাদের জামিন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল, কিন্তু যারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন তাদের সহজেই জামিন দেওয়া হয়েছিল ।   

সংবিধান আইনের চোখে সকল নাগরিকের সমতার নিশ্চয়তা দিলেও, গবেষণাগুলো দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক প্রয়োগের এক কঠোর বাস্তবতা প্রকাশ করে। এই মৌলিক বৈপরীত্য বিচার ব্যবস্থার একটি ভাঙ্গন নির্দেশ করে। বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণ, যেখানে রাজনৈতিক নিয়োগ এবং প্রভাব ফলাফল নির্ধারণ করে, তা এই সমস্যার মূল কারণ। এটি কেবল ব্যক্তিগত দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকদের বিষয় নয়, বরং একটি পদ্ধতিগত সমস্যা যেখানে আইনি কাঠামো নিজেই রাজনৈতিক নিপীড়নের জন্য "অস্ত্র" হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জামিন ব্যবস্থায় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অগ্রাধিকারমূলক আচরণ দরিদ্রদের দুর্দশার সাথে সরাসরি বৈপরীত্য তৈরি করে, একটি দৃশ্যমান দুই-স্তরীয় বিচার ব্যবস্থা তৈরি করে। মিথ্যা মামলা দায়েরকারীদের জবাবদিহিতার অভাব এই বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে, ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে বিরোধীদের হয়রানি করার সুযোগ দেয়। যখন বিচারকে নিরপেক্ষ সালিসদারের পরিবর্তে রাজনৈতিক ক্ষমতা বা ব্যক্তিগত প্রভাবের একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়, তখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিচার বিভাগের প্রতি জনআস্থা ভেঙে পড়ে। এই আস্থার অবক্ষয় সামাজিক অস্থিরতা এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে গভীর হতাশার জন্ম দেয়, যা একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের ধারণাকে মৌলিকভাবে দুর্বল করে। বিচারিক সংস্কারের আহ্বান এই গভীর সমস্যার একটি স্বীকৃতি, কিন্তু এর ঐতিহাসিক বাস্তবায়নে ব্যর্থতা জড়িত উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক বাধাগুলিকে তুলে ধরে।

বিচার বিভাগের দলীয়করণ ও স্বাধীনতা খর্ব

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষমতাসীন দলের ব্যাপক প্রভাবের কারণে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৪ সালের একটি বিতর্কিত সাংবিধানিক সংশোধনী সংসদকে বিচারকদের বরখাস্ত করার ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছিল, যা বিচার বিভাগের উপর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা হিসেবে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল । প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, একজন প্রধান বিচারপতি যিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রায়ের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার সাহস করেছিলেন, তাকে পরবর্তীতে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল, যা বিচার বিভাগের অন্যদের জন্য একটি ভীতিকর বার্তা পাঠিয়েছিল । এই পদ্ধতিগত সমস্যাগুলোর প্রতিক্রিয়ায়, অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশন গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালা পেশ করেছে, যার মধ্যে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা সীমিত করা, একটি স্বাধীন ফৌজদারি তদন্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা, মিথ্যা মামলা দায়ের প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন করা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের মেধা-ভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ।   

৪. ভিআইপি প্রোটোকল: রাস্তায় পুলিশ পাহারা ও সাধারণের কষ্ট

যানজট ও জনজীবনে দুর্ভোগ

ভিআইপি চলাচল, যদিও আপাতদৃষ্টিতে নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে করা হয়, তবে এটি অপ্রত্যাশিতভাবে উল্লেখযোগ্য যানজট সৃষ্টি করে, বিশেষ করে ঢাকার মতো শহরগুলোর পুরো অংশকে স্থবির করে দেয়। এটি বিশেষত পিক আওয়ারে সমস্যা তৈরি করে যখন যাত্রীরা মরিয়া হয়ে তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন । এর ফলস্বরূপ সাধারণ নাগরিকদের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়, মানসিক চাপ বাড়ে এবং ব্যাপক বিভ্রান্তি দেখা দেয়। বিশেষ করে গণপরিবহনের যাত্রীরা দীর্ঘ পথ ঘুরে যাওয়া, তীব্র ভিড় এবং যন্ত্রণাদায়ক বিলম্বের শিকার হন । এই সমস্যার ব্যাপকতা এই সত্য দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, এমনকি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও যানজটে আটকা পড়েছেন বলে জানা গেছে, যা ইঙ্গিত করে যে এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং লক্ষ লক্ষ মানুষের দৈনন্দিন বাস্তবতা ।   

জরুরি সেবায় বাধা: অ্যাম্বুলেন্সের দুর্দশা

ভিআইপি প্রোটোকল এবং সাধারণ যানজটের একটি হৃদয়বিদারক এবং নৈতিকভাবে নিন্দনীয় পরিণতি হলো জরুরি যানবাহন, বিশেষ করে অ্যাম্বুলেন্সের মারাত্মক বাধাগ্রস্ত হওয়া । এমন ঘটনা নথিভুক্ত আছে যেখানে অ্যাম্বুলেন্স, এমনকি গুরুতর অসুস্থ রোগী বা রক্তক্ষরণকারী শিশু বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও, ভিআইপি চলাচল বা সাধারণ যানজটের কারণে আটকা পড়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলেছেন যে, "একটি শিশুর জীবনের চেয়ে কি ভিআইপিরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?" । অ্যাম্বুলেন্স চালকরা প্রায়শই অভিযোগ করেন যে, সাধারণ মানুষ তাদের জন্য পথ ছাড়তে ইচ্ছুক নন, এবং ট্রাফিক সার্জেন্টরা সিগনাল ক্লিয়ার করার দাবি করলেও, স্বীকার করেন যে অ্যাম্বুলেন্স তাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকতে পারে, ফলে তারা আটকা পড়ে যায় । হাইকোর্টের একটি পর্যবেক্ষণ সত্ত্বেও যে, "ভিআইপি থাকলেও অ্যাম্বুলেন্সকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যেতে দেওয়া হয়, কারণ এখানে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন জড়িত," সমস্যাটি রয়েই গেছে, যা আইনি নির্দেশনা এবং বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে গভীর বিচ্ছিন্নতা এবং জীবনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে মানবিকতার অভাবকে নির্দেশ করে ।   

ভিআইপি প্রোটোকল, যা তীব্র যানজট সৃষ্টি করে এবং জরুরি পরিষেবাগুলোকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে, তা কেবল একটি অসুবিধা নয়; এটি শাসকগোষ্ঠী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর বিচ্ছিন্নতার একটি অত্যন্ত দৃশ্যমান এবং আবেগপূর্ণ প্রতীক। এটি শারীরিকভাবে প্রমাণ করে যে রাষ্ট্র একটি নির্বাচিত ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর সুবিধা ও নিরাপত্তাকে সাধারণ নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবন, অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা, সুস্থতা এবং এমনকি বেঁচে থাকার চেয়েও বেশি অগ্রাধিকার দেয়। অ্যাম্বুলেন্স আটকা পড়ার ঘটনা এবং জনগণের মর্মস্পর্শী প্রশ্ন ("একটি শিশুর জীবনের চেয়ে কি ভিআইপিরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?") এই সমস্যাটিকে কেবল একটি ট্রাফিক সমস্যা থেকে রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের নৈতিক অভিযোগের দিকে নিয়ে যায়। এটি এমন একটি ব্যবস্থাকে তুলে ধরে যেখানে তার কার্যনির্বাহী প্রোটোকলে মৌলিক মানবিকতার অভাব রয়েছে। এই অনুশীলন "মালিক-সেবক" মানসিকতাকে আরও শক্তিশালী করে, যেখানে নাগরিকদের নিয়ন্ত্রিত করার বিষয় হিসেবে দেখা হয়, শাসনব্যবস্থায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে নয়, যাদের সময় ও জীবনের মূল্য রয়েছে। জনদুর্ভোগ এবং এমনকি পুলিশের অভ্যন্তরেও সমস্যার স্বীকৃতি সত্ত্বেও এই প্রোটোকলগুলির অব্যাহত প্রয়োগ জনআস্থাকে ক্ষয় করে এবং গভীর অবিচারের জন্ম দেয়। এটি একটি স্পষ্ট বার্তা দেয় যে রাষ্ট্রের সম্পদ ও ক্ষমতা প্রাথমিকভাবে ক্ষমতাশালীদের সেবায় নিয়োজিত, সামগ্রিক জনকল্যাণে নয়, যা ব্যাপক জন অসন্তোষ এবং অসন্তুষ্টিতে অবদান রাখে।

৫. বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মীদের উপর হয়রানি

গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সিভিকাস মনিটর কর্তৃক বাংলাদেশের নাগরিক পরিসরকে উদ্বেগজনকভাবে 'বন্ধ' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা এর সর্বনিম্ন রেটিং। এই গুরুতর মূল্যায়ন জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী রাজনীতিবিদ এবং স্বাধীন সমালোচকদের উপর "ব্যাপক সরকারি দমন-পীড়নের" সরাসরি ফল । কর্তৃপক্ষ পদ্ধতিগতভাবে মানবাধিকার কর্মী, বিক্ষোভকারী এবং সমালোচকদের উপর নৃশংস কৌশল প্রয়োগ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ভীতি প্রদর্শন, সহিংসতা, নির্বিচার গ্রেপ্তার এবং নির্যাতন ।   

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের ব্যাপক গণগ্রেপ্তার ও বিচার চলছে, প্রায়শই নির্যাতন ও হত্যার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ সহ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ শুধুমাত্র ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে প্রায় ১০,০০০ বিরোধী কর্মীকে গ্রেপ্তার এবং ৫,৫০০ জনের বেশি আহত হওয়ার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে । বিরোধী কর্মীদের বাড়িতে পুলিশের অভিযান, যেখানে লক্ষ্যবস্তুদের না পেলে পরিবারের সদস্যদের হয়রানি করা হয়, তা সাধারণ ঘটনা। অনেক গ্রেপ্তার রাজনৈতিক কর্মসূচির সময় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর এবং সহিংসতার কথিত অভিযোগে করা হয়, প্রায়শই যথেষ্ট প্রমাণ ছাড়াই ।   

সরকার প্রায়শই বিরোধী দলকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মতো কঠোর আইন ব্যবহার করে। একটি সাধারণ কৌশল হলো বিরোধী সদস্যদের বিরুদ্ধে পুরনো, নিষ্ক্রিয় মামলা দায়ের করা, কার্যকরভাবে আইনি ব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা । আওয়ামী লীগ নিজেই ইউনূস সরকারের অধীনে "রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা মামলার" বৃদ্ধির কথা জানিয়েছে, যেখানে প্রায়শই একই ধরনের স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করে শত শত "অজ্ঞাতনামা অভিযুক্ত" ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয় এবং বিশিষ্ট বিরোধী ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও আইনজীবীদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এই মামলাগুলোতে প্রায়শই কোনো সারবত্তা বা পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত থাকে না, এবং স্থানীয় পুলিশ বা রাজনৈতিক কর্মীরা ইচ্ছামতো নাম যুক্ত করে । বিচার বিভাগকে ক্রমবর্ধমানভাবে রাজনৈতিক নিপীড়নের একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলি নিয়মিতভাবে প্রকৃত ন্যায়বিচারের অনুসন্ধানকে ছাপিয়ে যায়। উদ্বেগজনকভাবে, এই বানোয়াট মামলা দায়েরকারীদের জন্য জবাবদিহিতার ব্যাপক অভাব রয়েছে । শেখ হাসিনার শাসনামলে (২০০৯-২০২৪) বিরোধী কর্মীদের অপহরণ, আটক এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড "সাধারণ অনুশীলন" ছিল, যেখানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এজেন্টদের দ্বারা ৭৫০টিরও বেশি নথিভুক্ত গুমের ঘটনা ঘটেছে। র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) একাই এই সময়ে প্রায় ৬০০ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত হয়েছিল ।   

বাকস্বাধীনতা ও সমাবেশের অধিকার খর্ব

যারা রাষ্ট্রীয় অপব্যবহার উন্মোচন করার সাহস করেছিলেন, সেই সাংবাদিকদের পদ্ধতিগতভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল এবং সমালোচনামূলক গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) দমনমূলক ভাষা অনেকটাই ধরে রেখেছে, যা হাজার হাজার অনলাইন সমালোচককে অপরাধী সাব্যস্ত করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল । মানবাধিকার কর্মী ও লেখকরা কারাবন্দী ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, একজন বিশিষ্ট লেখক সরকারের কোভিড-১৯ প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা করার পর দুঃখজনকভাবে কারাগারে মারা গেছেন । পুলিশ বিরোধী বিক্ষোভ, সেইসাথে পোশাক শ্রমিক এবং গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের বিক্ষোভ সহিংসভাবে দমন করেছে, প্রায়শই অসামঞ্জস্যপূর্ণ শক্তি ব্যবহার করে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) বিক্ষোভের সময় সহিংস ঘটনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, রাজনৈতিক অভিনেতাদের উস্কানি থেকে বিরত থাকতে এবং পুলিশকে আনুপাতিক ও আইনসম্মতভাবে শক্তি ব্যবহার করার আহ্বান জানিয়েছে । জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে, ৩০১টি সুপারিশ জারি করেছে। এর মধ্যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা (অনলাইন ও অফলাইন উভয়ই) সম্পর্কিত আইন সংশোধন এবং পুলিশ বাহিনীর জন্য পর্যাপ্ত মানবাধিকার প্রশিক্ষণের জরুরি আহ্বান অন্তর্ভুক্ত ছিল ।   

বিরোধী দলের কর্মীদের উপর হয়রানির ঘটনাগুলি একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের চিত্র তুলে ধরে, যেখানে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে রাজনৈতিক টিকে থাকার জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনের পদ্ধতিগত, ধারাবাহিক এবং ব্যাপক প্রকৃতি একটি সুচিন্তিত কৌশলের ইঙ্গিত দেয়। এই কৌশলটিতে আইনি ব্যবস্থাকে (মিথ্যা মামলা, পুরনো অভিযোগ, ডিএসএ/সিএসএ-এর মতো কঠোর আইন ব্যবহার করে), আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলিকে (পুলিশ, র‍্যাব, ডিজিএফআই-এর মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন) এবং এমনকি বিচারবহির্ভূত সহিংসতাকে (ক্ষমতাসীন দলের সহযোগীদের দ্বারা আক্রমণ) সুপরিকল্পিতভাবে "অস্ত্র" হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিগত দমন-পীড়নের মূল উদ্দেশ্য হলো রাজনৈতিক টিকে থাকা এবং ক্ষমতা সংহত করা। রাজনৈতিক বিরোধীদের নিষ্ক্রিয় করে এবং সমালোচকদের নীরব করে, ক্ষমতাসীন দল তার আধিপত্য নিশ্চিত করে এবং জবাবদিহিতাকে সীমিত করে। "বন্ধ" নাগরিক পরিসরের রেটিং এই কৌশলের একটি প্রত্যক্ষ ফলাফল। দুর্নীতি দমন কমিশন এবং বিচার বিভাগের মতো তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলির রাজনৈতিকীকরণ এবং দুর্বলতা এই প্রক্রিয়াকে সম্ভব করে তোলে, কারণ এটি চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স সরিয়ে দেয় এবং অপরাধীদের প্রায়শই দায়মুক্তির সাথে কাজ করার সুযোগ দেয়। মিথ্যা অভিযোগকারীদের জবাবদিহিতার অভাব এই ব্যবস্থাকে আরও গভীরভাবে প্রোথিত করে। এই পদ্ধতিগত দমন-পীড়ন গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের মূল নীতিগুলিকে মৌলিকভাবে দুর্বল করে। এটি ভয়ের একটি ব্যাপক পরিবেশ তৈরি করে, বৈধ রাজনৈতিক আলোচনাকে স্তব্ধ করে দেয় এবং যেকোনো অর্থপূর্ণ জবাবদিহিতার পথ বন্ধ করে দেয়, যা একটি "ক্ষতিগ্রস্ত গণতন্ত্র"-এর দিকে নিয়ে যায়। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারগুলি (যেমন ইউনূস সরকার) সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে, তবে মিথ্যা মামলার ধারাবাহিকতা এবং গভীর প্রোথিত সংস্কার বাস্তবায়নে অন্তর্নিহিত চ্যালেঞ্জগুলি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূখণ্ডে এই কর্তৃত্ববাদী প্যাথলজি কতটা গভীরভাবে প্রোথিত তা তুলে ধরে।

৬. প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণ: পরিচিত বা ক্ষমতাধর হলে সুবিধা

প্রশাসনে স্বজনপ্রীতি ও অদক্ষতা

বাংলাদেশে দুর্নীতি কেবল উপস্থিত নয়, বরং এটি জনপ্রশাসনের প্রতিটি স্তরেই ছড়িয়ে আছে, যা ঘুষ, পক্ষপাতিত্ব এবং স্বজনপ্রীতির ব্যাপক সংস্কৃতির মাধ্যমে জনসেবার দক্ষ বিতরণকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে । স্বজনপ্রীতি বাংলাদেশের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত, যেখানে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং পারিবারিক বন্ধন বস্তুনিষ্ঠ যোগ্যতা এবং প্রমাণিত মেধার চেয়ে ধারাবাহিকভাবে অগ্রাধিকার পায়। এটি কম দক্ষ কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হতে সাহায্য করে, যার ফলে জনপ্রশাসনের সামগ্রিক দক্ষতা ও অখণ্ডতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় । পক্ষপাতিত্ব ও অদক্ষতার এই গভীর প্রোথিত অনুশীলন বিদেশি বিনিয়োগকে সক্রিয়ভাবে নিরুৎসাহিত করে, কারণ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা এমন ব্যবসায়িক পরিবেশ পছন্দ করেন যেখানে কর্মচারীদের মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়, ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে নয় ।   

বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা কুখ্যাতভাবে অতিরিক্ত লাল ফিতা, অকার্যকর পদ্ধতি এবং ব্যাপক দুর্নীতিতে জর্জরিত, যা সিভিল সার্ভিসে উল্লেখযোগ্য অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণ হয় এবং শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতাকে পঙ্গু করে দেয়। ম্যানুয়াল সিস্টেম, শ্রেণীবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আমলাতন্ত্রের মধ্যে ভাড়া-সন্ধানী আচরণ প্রশাসনিক ব্যয়কে নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে তোলে এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে পঙ্গুকারী বিলম্ব ঘটায় । দেশের আমলাতন্ত্রকে স্পষ্টভাবে "ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের একটি অবশেষ" হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা জাতির অগ্রগতি সাধনের চেয়ে নিজের বিশেষাধিকার রক্ষায় বেশি আগ্রহী বলে মনে হয়। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রায়শই "রাজকীয়" আচরণ প্রদর্শন করেন, যা ঔপনিবেশিক আমলের শ্রদ্ধার কথা মনে করিয়ে দেয় ।   

ঔপনিবেশিক মানসিকতা ও নাগরিকের প্রতি অবজ্ঞা

প্রশাসনিক ব্যবস্থা, যা মূলত বিদেশি ঔপনিবেশিক শাসকদের সেবা করার জন্য ধারণা ও নকশা করা হয়েছিল, এখন প্রধানত তার নিজস্ব সুপ্রতিষ্ঠিত বিশেষাধিকার রক্ষায় আগ্রহী বলে মনে হয়। এটি পুরনো পদ্ধতিগুলোকে স্থায়ী করে এবং সাধারণ নাগরিকদের জনসেবা পেতে অপ্রয়োজনীয় বাধা তৈরি করে । এই অদক্ষতার একটি প্রকট উদাহরণ হলো "নোটং সিস্টেম," একটি কষ্টকর আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যেখানে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে ফাইলগুলোকে মন্তব্য ও অনুমোদনের জন্য একাধিক হাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই ব্যবস্থা প্রচুর সময় ও সরকারি অর্থ নষ্ট করে যা স্কুল ও হাসপাতালের মতো গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নমূলক উদ্যোগের জন্য বরাদ্দ করা যেতে পারত ।   

এই গভীরভাবে প্রোথিত ব্যবস্থা নাগরিকদেরকে কেবল "নিয়ন্ত্রিত করার বিষয়" হিসেবে দেখে, শাসনব্যবস্থায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে নয়। ক্ষমতা মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় সাধারণ মানুষের তাদের জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে এমন সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে সীমিত হয় । ক্ষমতার এই কেন্দ্রীভবন, ব্যাপক প্রশাসনিক বিবেচনার সাথে মিলিত হয়ে, মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে, যদিও সরকারি কর্মচারীদের সংবিধান অনুযায়ী জনগণের সেবা করার কর্তব্য রয়েছে ।   

লাইসেন্স ও পারমিট প্রদানে রাজনৈতিক প্রভাব

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান প্রকাশ করেছেন যে, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সময় "গণমাধ্যম মালিকদের রাজনৈতিক পরিচয়" বিবেচনা করে গণমাধ্যম লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছিল, খোলা ও স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নয়। এটি বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন ধরনের পারমিট ও লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের একটি ব্যাপক, পদ্ধতিগত প্যাটার্নের ইঙ্গিত দেয় । গণমাধ্যম খাতে "কালো টাকা" ঢোকানো নিয়ে উদ্বেগ উত্থাপিত হয়েছে, যেখানে গণমাধ্যম মালিকদের বিনিয়োগের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন রয়ে গেছে, যা আর্থিক স্বচ্ছতার অভাবকে তুলে ধরে । ভূমি প্রশাসন খাতে দুর্নীতি ব্যাপক, যেখানে কোম্পানিগুলো প্রায়শই নির্মাণ অনুমতি পেতে অনানুষ্ঠানিক অর্থ প্রদানের প্রত্যাশা করে এবং জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ উদ্বেগজনকভাবে সাধারণ। কর্মকর্তারা আইন উপেক্ষা করতে বা লেনদেন দ্রুত করতে ঘুষ নিতে পরিচিত, এবং সরকার রাজনৈতিক সংযোগ ও আর্থিক প্রভাবের ভিত্তিতে জমির অধিকার দিতে বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে, আইনি যোগ্যতা বা জনস্বার্থের ভিত্তিতে নয় ।   

প্রশাসনে ব্যাপক স্বজনপ্রীতি, অদক্ষতা এবং "ঔপনিবেশিক মানসিকতা" বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি একটি গভীরভাবে প্রোথিত আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার লক্ষণ। এই ব্যবস্থা সহজাতভাবে পরিবর্তনের প্রতি প্রতিরোধী, এমনকি ডিজিটাল শাসনব্যবস্থা গ্রহণেও, কারণ এর বর্তমান কাঠামো এর অভ্যন্তরে থাকা ব্যক্তিদের স্বার্থ রক্ষা করে। আমলাতন্ত্র, যাকে "ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবশেষ" হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে "নিজের বিশেষাধিকার রক্ষায়" আগ্রহী। এই আত্মস্বার্থ-প্রণোদিত উদ্দেশ্য সংস্কারের প্রতি তাদের প্রতিরোধের ব্যাখ্যা দেয়, যা তাদের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণকে হুমকির মুখে ফেলবে। লাইসেন্স প্রদানে রাজনৈতিক পরিচয় এবং ভূমি প্রশাসনে ব্যাপক দুর্নীতি প্রমাণ করে যে প্রশাসনিক প্রক্রিয়াগুলি, যা নিরপেক্ষ ও জনসেবামূলক হওয়া উচিত, তার পরিবর্তে রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের সুবিধা দিতে "অস্ত্র" হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি জনসেবাকে একটি অধিকার থেকে অনুগ্রহে রূপান্তরিত করে, যা কেবল সংযোগ বা ঘুষের মাধ্যমে পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিগত পক্ষপাতিত্ব বৈধ অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে বাধাগ্রস্ত করে, বিদেশি বিনিয়োগকে সক্রিয়ভাবে নিরুৎসাহিত করে এবং সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে গভীর ক্ষমতাহীনতার অনুভূতি তৈরি করে। এর চূড়ান্ত পরিণতি হলো একটি রাষ্ট্রীয় যন্ত্র যা জনগণের সেবা করার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে মৌলিকভাবে ব্যর্থ হয়, যা ব্যাপক জন অসন্তোষ, গভীর শাসন সংকট এবং রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের মধ্যে ব্যবধান বাড়িয়ে তোলে।

৭. বৈষম্যের গভীর প্রভাব: একটি ভঙ্গুর সমাজের চিত্র

অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি ও সামাজিক অস্থিরতা

আকর্ষণীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান সত্ত্বেও, বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান বৈষম্যে জর্জরিত। এটি "অতি ধনী" ব্যক্তিদের দ্রুত বৃদ্ধি এবং একই সাথে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়া জনসংখ্যার একটি ক্রমবর্ধমান অংশের মধ্যে একটি স্পষ্ট আর্থ-সামাজিক বিভাজন হিসেবে প্রকাশ পায় । বাংলাদেশের গিনি সহগ "উদ্বেগজনকভাবে উচ্চ" রয়ে গেছে, যা সারা দেশে গভীর সম্পদ বৈষম্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে কাজ করে। এই অর্থনৈতিক বৈষম্য বিশেষ করে উচ্চ দারিদ্র্য হারের অঞ্চলগুলিতে তীব্র, যা ইতিমধ্যে দুর্বল গোষ্ঠীগুলিকে আরও প্রান্তিক করে তোলে । দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা এবং ব্যাপক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ক্ষয়কারী প্রভাবগুলি গভীর অর্থনৈতিক বৈষম্যকে সরাসরি বাড়িয়ে তোলে। এটি জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশের জন্য অপরিহার্য অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারগুলিতে প্রবেশাধিকারকেও মারাত্মকভাবে সীমিত করে । এই পদ্ধতিগত অবিচারগুলি জনসংখ্যার বিভিন্ন স্তরের মধ্যে গভীর অভিযোগের জন্ম দেয়, যা "রাজনীতি ও শাসনের ধ্বংসাত্মক ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্যাথলজি" হিসেবে বর্ণনা করা হয় ।   

জনগণের আস্থা হ্রাস ও সুশাসনের সংকট

দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রকৃত রাজনৈতিক ইচ্ছার ব্যাপক অভাব সুস্পষ্ট, যদিও বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলির মধ্যে ধারাবাহিকভাবে স্থান করে নিয়েছে। এই বৈপরীত্য সুশাসনের প্রতি যেকোনো অঙ্গীকারকে দুর্বল করে । বিচার বিভাগ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সহ প্রায় সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক রাজনৈতিকীকরণ মৌলিকভাবে জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতাকে দুর্বল করে, এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করে যেখানে দায়মুক্তি বৃদ্ধি পায় । প্রশাসনের প্রতি জন অসন্তোষ ব্যাপক এবং গভীরভাবে অনুভূত। অনেক নাগরিক মনে করেন যে ঘুষ না দিয়ে অপরিহার্য পরিষেবা পাওয়া অসম্ভব, এবং একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মনে করে যে সরকারি কর্মচারীরা জনগণের সেবক না হয়ে "শাসকদের" মতো আচরণ করে । অর্থপূর্ণ সংস্কার বাস্তবায়নে ধারাবাহিক ব্যর্থতা, যা প্রায়শই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলির শক্তিশালী প্রভাব এবং পরিবর্তনের জন্য সমাজের দুর্বল চাহিদার কারণে ঘটে, এই গভীর শাসন সংকটকে স্থায়ী করে ।   

মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ

মানবাধিকার লঙ্ঘন উদ্বেগজনকভাবে ঘন ঘন এবং পদ্ধতিগত, যার মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্বিচার গ্রেপ্তার এবং নির্যাতন অন্তর্ভুক্ত, যা প্রায়শই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা সংঘটিত হয় । দেশের নাগরিক পরিসরকে 'বন্ধ' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা রাজনৈতিক বিরোধী দল, স্বাধীন সমালোচক এবং নাগরিক সমাজের উপর একটি গুরুতর এবং পদ্ধতিগত সরকারি দমন-পীড়নকে প্রতিফলিত করে । মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সীমিত, যেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) এবং এর উত্তরসূরি, সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ)-এর মতো কঠোর আইনগুলি ভিন্নমত দমন, অনলাইন বক্তব্যকে অপরাধী করা এবং সাংবাদিকদের হয়রানি করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় । রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে "অস্ত্র" হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা সমালোচনামূলকভাবে "ক্ষতিগ্রস্ত গণতন্ত্র" হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যেখানে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং প্রতিষ্ঠানগুলি পদ্ধতিগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে ।   

বৈষম্যের বিভিন্ন রূপ এবং দুর্নীতির সম্মিলিত প্রভাব রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের মধ্যে সামাজিক চুক্তির একটি গভীর এবং পদ্ধতিগত ক্ষয় ঘটায়। যখন ঘুষ ছাড়া জনসেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, দরিদ্রদের বিচার পদ্ধতিগতভাবে অস্বীকার করা হয়, রাজনৈতিক ভিন্নমতকে অপরাধী করা হয় এবং মৌলিক মানবাধিকার প্রায়শই দায়মুক্তির সাথে লঙ্ঘিত হয়, তখন রাষ্ট্র তার নৈতিক কর্তৃত্ব এবং জনগণের চোখে বৈধতা হারায়। নাগরিকরা রাষ্ট্রকে ক্ষমতাশালীদের সেবায় নিয়োজিত বলে মনে করে। সামাজিক চুক্তির এই ভাঙ্গন ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতা এবং অস্থিতিশীলতার জন্য একটি উর্বর এবং বিপজ্জনক পরিবেশ তৈরি করে। দুর্নীতিগ্রস্ত অনুশীলনের দ্বারা সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অভিযোগগুলিকে আরও বাড়িয়ে তোলে, কারণ অর্থনৈতিক লাভগুলি ন্যায়সঙ্গতভাবে বিতরণ হয় না, যা সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে গভীর অবিচার এবং প্রান্তিকতার অনুভূতি তৈরি করে। শাসনের এই পদ্ধতিগত ব্যর্থতা বাংলাদেশকে একটি ক্রমবর্ধমান ভঙ্গুর সমাজে রূপান্তরিত করে, যেখানে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের মূল ভিত্তিগুলি মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এটি দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, প্রকৃত টেকসই উন্নয়নে বাধা এবং সম্ভাব্যভাবে দেশকে আরও কর্তৃত্ববাদের দিকে বা ব্যাপক জন অসন্তোষের দিকে ঠেলে দেয়, যা পূর্ববর্তী সরকারের পতন এবং সহিংস বিক্ষোভের মাধ্যমে দুঃখজনকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। "সংস্কারের জন্য দুর্বল সামাজিক চাহিদা" একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুপস্থিত উপাদান, যা ইঙ্গিত করে যে জন অসন্তোষ এতটাই গভীর হতে পারে যে এটি সংগঠিত চাপের পরিবর্তে উদাসীনতা হিসেবে প্রকাশ পায়, যা সংস্কারের কাজকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তোলে।

৮. পরিবর্তনের আহ্বান: একটি ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের পথে

প্রস্তাবিত সংস্কারসমূহ: একটি রোডম্যাপ

ব্যাপক ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের পর ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার একটি উচ্চাভিলাষী ম্যান্ডেট বহন করে: অতীতের অন্যায়ের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, মূল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে মৌলিকভাবে সংস্কার করা এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করা । এই ম্যান্ডেট পূরণের লক্ষ্যে, ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে, যার প্রতিটি শাসনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো মোকাবেলা করার দায়িত্বপ্রাপ্ত: সাংবিধানিক সংস্কার, নির্বাচনী সংস্কার, পুলিশ সংস্কার, দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন সংস্কার এবং বিচার বিভাগীয় সংস্কার ।   

এই কমিশনগুলির মূল সুপারিশগুলির মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-কে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করা এবং উচ্চ-পর্যায়ের ব্যক্তিদের জবাবদিহি করার ক্ষমতা দেওয়া, যার ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা এবং তাদের পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা । বিচার বিভাগীয় সংস্কার প্রস্তাবগুলির মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা সীমিত করা, একটি স্বাধীন ফৌজদারি তদন্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা, মিথ্যা মামলা দায়ের প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন করা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের জন্য মেধা-ভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা । জনপ্রশাসন সংস্কারের সুপারিশগুলির মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়া, জাতীয় সততা ব্যবস্থা (NIS) শক্তিশালী করা, স্বজনপ্রীতি প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়া এবং হুইসেলব্লোয়ারদের সুরক্ষা দেওয়া । ভারসাম্যপূর্ণ আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বন্টন নিশ্চিত করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে । ভিআইপি প্রোটোকল সংস্কারের ক্ষেত্রে পুলিশ প্রোটোকল হ্রাস এবং লাল গালিচা বাতিল করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে । তবে, এই সংস্কারগুলির সফল বাস্তবায়নের জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সমাজের পক্ষ থেকে পরিবর্তনের জোরালো দাবি অপরিহার্য ।   

উপসংহার: একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক ভবিষ্যতের দিকে

উপসংহারে বলা যায়, বাংলাদেশ একটি গুরুতর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে পদ্ধতিগত বৈষম্য সমাজের প্রতিটি স্তরে গভীর প্রভাব ফেলছে। এই প্রতিবেদনে আলোচিত সমস্যাগুলি—সরকারি চাকরিতে দুর্নীতি, প্রকল্প বাস্তবায়নে পক্ষপাতিত্ব, বিচারিক বৈষম্য, ভিআইপি প্রোটোকলের কারণে জনদুর্ভোগ, বিরোধী দলের কর্মীদের হয়রানি এবং প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণ—কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এগুলি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার গভীর শিকড়ের ফল।

বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলি গভীরভাবে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার মধ্যে নিহিত। একটি কার্যকর এবং ন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কেবল উপরিভাগের পরিবর্তন যথেষ্ট নয়; এর জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে একটি মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা অপরিহার্য।

প্রকৃত সংস্কারের জন্য কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, বরং দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং বাস্তব পদক্ষেপ প্রয়োজন। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম এবং সচেতন নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই পরিবর্তনের চালিকা শক্তি হতে পারে। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, জবাবদিহিমূলক এবং ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্ন তখনই বাস্তবায়িত হবে, যখন শাসনব্যবস্থা মুষ্টিমেয় ক্ষমতাশালীর পরিবর্তে সকল নাগরিকের সেবা করবে। এই পথ কঠিন হলেও, একটি উন্নত ভবিষ্যতের জন্য এটি অপরিহার্য।

🗣️ পাঠকদের উদ্দেশ্যে বার্তা:

প্রিয় পাঠক,
আমাদের চারপাশের সমাজে যে বৈষম্য, অন্যায় ও পক্ষপাত বিরাজমান—তা বদলাতে হলে আমাদের আগে সচেতন হতে হবে। ক্ষমতার রাজনীতি আর প্রশাসনিক সুবিধাবাদের বাইরে গিয়েই আমরা চাই একটি ন্যায়ের সমাজ।

আপনার চোখে যদি এদেশের গরিব, সাধারণ মানুষ বা নিপীড়িত কেউ অবিচারের শিকার হন—তবে সেই কণ্ঠস্বর তুলে ধরুন। "কল্পকথা-৩৬০" আপনার প্ল্যাটফর্ম।

🖋️ আপনার মতামত, অভিজ্ঞতা বা প্রতিবাদমূলক গল্প আমাদের পাঠান। একসাথে কথা বললেই পরিবর্তন সম্ভব।

কল্পকথা ৩৬০

"কল্পনা যেখানে জীবনের গল্প বলে…" Kalpakatha 360 কেবল একটি ব্লগ নয়, এটি অনুভবের এক পূর্ণচক্র। জীবনের প্রতিটি দিক—ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, নস্টালজিয়া, সমাজ, আত্মউপলব্ধি—এই ব্লগে গল্প হয়ে ধরা দেয় শব্দের ভাষায়। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি মানুষের ভেতরেই লুকিয়ে আছে একটি কল্পকথা—কারওটা বলা হয়, কারওটা থেকে যায় না বলা। সেই অনুচ্চারিত গল্পগুলোই এখানে খুঁজে পায় কণ্ঠ। এই ব্লগে আপনি পাবেন: ছোটগল্প ও জীবনভিত্তিক উপন্যাস কবিতা ও ছন্দে বাঁধা অনুভূতি সমাজ সচেতন প্রবন্ধ ও বিশ্লেষণ আত্মউপলব্ধি, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা সময়োপযোগী ভাবনা ও লেখকদের মুক্ত মত প্রকাশ আমরা চাই—আপনি হোন আমাদের পাঠক, সহচর, অথবা গল্পকার। কারণ "Kalpakatha 360" শুধু আমাদের কথা বলে না, এটি আমাদের সকলের কল্পনাকে ছুঁয়ে যায়।

1 Comments

🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।

শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com

  1. "গভীর বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। এই পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি, শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ।"

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post