মা, বাবা, সন্তান—ভালোবাসার নাম হলেও পারিবারিক ভাঙন বাড়ছে। সমাধান চাই সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায়।
বাংলাদেশে পিতা-মাতা ও সন্তানের সম্পর্ক চিরকালই পবিত্র, অটুট ও আত্মিক বলে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু সেই সম্পর্কেই যখন হানা দেয় মৃত্যুর অন্ধকার, তখন সমাজ স্তব্ধ হয়ে যায়। একবিংশ শতাব্দীর এই সমাজে, সন্তানের জন্মদাতা মা-বাবাই যখন হত্যাকারী হয়ে ওঠেন, তখন প্রশ্ন ওঠে—'এতটা নৃশংসতা কোথা থেকে জন্ম নেয়?' দ্বিতীয় পর্বে আমরা বিশ্লেষণ করব সেইসব মর্মান্তিক ঘটনাগুলো যেখানে মা বা বাবা নিজেদের সন্তানকে হত্যা করেছেন। একইসঙ্গে পর্যালোচনা করব হত্যাচেষ্টা এবং আত্মহত্যার কাহিনিগুলো।
চট্টগ্রাম, ফটিকছড়ি – পারিবারিক দ্বন্দ্বে আনিকা’র মৃত্যু
জানুয়ারি ২০২৫। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে পারিবারিক ঝগড়ার এক পর্যায়ে আনিকা আক্তার (২৫) নিহত হন। তার মা রোখসানা আক্তার ও ভাই রোকন উদ্দিন তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেন। ঘটনার পেছনে ছিল সম্পত্তি ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব। আনিকা ছিলেন পরিবারের শিক্ষিত ও স্বাধীনচেতা নারী, যাকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টাই তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।
এই ঘটনাটি আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়—নারী যখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়, তখন তার পরিবারই কি কখনো প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে না? আনিকার মৃত্যু যেন সেই প্রশ্নেরই এক রক্তাক্ত উত্তর।
বরিশাল, আগৈলঝাড়া – এক নবজাতকের গলা টিপে হত্যা
এপ্রিল ২০২৩। বরিশালের আগৈলঝাড়ায় রুমা বেগম (২৪) তার সদ্যোজাত কন্যাকে গলায় রশি পেঁচিয়ে হত্যা করেন। কারণ? পরপর তৃতীয় সন্তানও মেয়ে হওয়া। সমাজে কন্যাসন্তানকে এখনও বোঝা মনে করার ভয়াবহ মানসিকতা এখানেই চরম আকারে প্রকাশ পেয়েছে।
এই ঘটনা শুধু একটি খুন নয়; এটি আমাদের সমাজে বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্য, কুসংস্কার এবং নারীবিদ্বেষের এক নগ্ন রূপ। একজন মা যখন নিজের মেয়ে শিশুকে হত্যা করে, তখন শুধুই তার দোষ খোঁজা যথেষ্ট নয়—সন্দেহের চোখে দেখতে হয় পুরো সমাজকে।
চট্টগ্রাম, রাউজান – মায়ের প্রাণনাশের চেষ্টা
মার্চ ২০২৪। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে দুই ছেলে সুমন ও অনুপম বড়ুয়া তাদের মা মিনু রানী বড়ুয়াকে গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করেন। যদিও মা প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু সন্তানদের হাতে তার সেই মৃত্যুআশঙ্কার ভয় কখনও ভোলার নয়। এই ঘটনা আইনানুগভাবে সমাধান পেলেও পারিবারিক বিশ্বাস চুরমার হয়ে গেছে চিরতরে।
ঢাকা, শেরেবাংলা নগর – সন্তান হত্যার পর আত্মহত্যা
এপ্রিল ২০২৪। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে মশিউর রহমান তার ছেলে সাদাবকে শ্বাসরোধে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেন। একইসঙ্গে তিনি মেয়ে সিনথিয়াকে হত্যার চেষ্টা করেন, তবে সে বেঁচে যায়। পারিবারিক বিরোধ ও মানসিক অবসাদ থেকে জন্ম নেওয়া এই ঘটনা ছিল এক গভীর ট্র্যাজেডি।
এখানে প্রশ্ন আসে—আমাদের সমাজে কি পর্যাপ্ত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা আছে? কীভাবে একজন পিতা এমন চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, যেখানে নিজের সন্তানকে হত্যা করাও হয়ে ওঠে মুক্তি পাওয়ার পথ?
পারিবারিক অন্ধকারের অন্তরালে
এই ঘটনাগুলোর পেছনে রয়েছে কিছু সাধারণ কারণ:
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা
পারিবারিক ও সামাজিক চাপ
সম্পত্তির দ্বন্দ্ব ও আর্থিক অনিশ্চয়তা
লিঙ্গবৈষম্য ও কুসংস্কার
অসহায়ত্বের চূড়ান্ত প্রকাশ
এগুলো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়; প্রতিটিই আমাদের সমাজের গভীর ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। মা যখন সন্তান হত্যা করেন, সেটা হয়তো তাৎক্ষণিক উন্মাদনা; কিন্তু সেই উন্মাদনার পেছনে থাকে এক অব্যক্ত আর্তনাদ—যা হয়তো কখনও শোনা হয়নি।
করণীয়
সবার আগে দরকার সচেতনতা। পরিবারে দ্বন্দ্ব দেখা দিলেই তা গোপন না রেখে কাউন্সেলিং নেওয়া উচিত।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য ও গ্রহণযোগ্য করতে হবে।
পারিবারিক শিক্ষার প্রয়োজন – যেখানে সম্মান, শ্রদ্ধা, সহনশীলতা শেখানো হয়।
মাদকবিরোধী কার্যক্রম আরও জোরদার করা উচিত।
উপসংহার
মা, বাবা, সন্তান – এই তিনটি নামই ভালোবাসার প্রতীক। কিন্তু সমাজে যে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে, তা আমাদের এই মুল্যবোধগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। পারিবারিক কাঠামোর এই ভাঙন ঠেকাতে হলে, আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে। শুধু আইন নয়, সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির জায়গা থেকেও সমাধান খুঁজতে হবে।
পরবর্তী পর্বে আমরা আলোচনা করব—এইসব অপরাধীদের ভবিষ্যৎ পরিণতি, বিচারব্যবস্থা এবং কীভাবে সমাজ এগিয়ে যেতে পারে এমন অন্ধকার সময় পার করে।
বাংলাদেশে পিতা-মাতা ও সন্তানের সম্পর্ক চিরকালই পবিত্র, অটুট ও আত্মিক বলে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু সেই সম্পর্কেই যখন হানা দেয় মৃত্যুর অন্ধকার, তখন সমাজ স্তব্ধ হয়ে যায়। একবিংশ শতাব্দীর এই সমাজে, সন্তানের জন্মদাতা মা-বাবাই যখন হত্যাকারী হয়ে ওঠেন, তখন প্রশ্ন ওঠে—'এতটা নৃশংসতা কোথা থেকে জন্ম নেয়?' দ্বিতীয় পর্বে আমরা বিশ্লেষণ করব সেইসব মর্মান্তিক ঘটনাগুলো যেখানে মা বা বাবা নিজেদের সন্তানকে হত্যা করেছেন। একইসঙ্গে পর্যালোচনা করব হত্যাচেষ্টা এবং আত্মহত্যার কাহিনিগুলো।
চট্টগ্রাম, ফটিকছড়ি – পারিবারিক দ্বন্দ্বে আনিকা’র মৃত্যু
জানুয়ারি ২০২৫। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে পারিবারিক ঝগড়ার এক পর্যায়ে আনিকা আক্তার (২৫) নিহত হন। তার মা রোখসানা আক্তার ও ভাই রোকন উদ্দিন তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেন। ঘটনার পেছনে ছিল সম্পত্তি ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব। আনিকা ছিলেন পরিবারের শিক্ষিত ও স্বাধীনচেতা নারী, যাকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টাই তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।
এই ঘটনাটি আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়—নারী যখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়, তখন তার পরিবারই কি কখনো প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে না? আনিকার মৃত্যু যেন সেই প্রশ্নেরই এক রক্তাক্ত উত্তর।
বরিশাল, আগৈলঝাড়া – এক নবজাতকের গলা টিপে হত্যা
এপ্রিল ২০২৩। বরিশালের আগৈলঝাড়ায় রুমা বেগম (২৪) তার সদ্যোজাত কন্যাকে গলায় রশি পেঁচিয়ে হত্যা করেন। কারণ? পরপর তৃতীয় সন্তানও মেয়ে হওয়া। সমাজে কন্যাসন্তানকে এখনও বোঝা মনে করার ভয়াবহ মানসিকতা এখানেই চরম আকারে প্রকাশ পেয়েছে।
এই ঘটনা শুধু একটি খুন নয়; এটি আমাদের সমাজে বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্য, কুসংস্কার এবং নারীবিদ্বেষের এক নগ্ন রূপ। একজন মা যখন নিজের মেয়ে শিশুকে হত্যা করে, তখন শুধুই তার দোষ খোঁজা যথেষ্ট নয়—সন্দেহের চোখে দেখতে হয় পুরো সমাজকে।
চট্টগ্রাম, রাউজান – মায়ের প্রাণনাশের চেষ্টা
মার্চ ২০২৪। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে দুই ছেলে সুমন ও অনুপম বড়ুয়া তাদের মা মিনু রানী বড়ুয়াকে গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করেন। যদিও মা প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু সন্তানদের হাতে তার সেই মৃত্যুআশঙ্কার ভয় কখনও ভোলার নয়। এই ঘটনা আইনানুগভাবে সমাধান পেলেও পারিবারিক বিশ্বাস চুরমার হয়ে গেছে চিরতরে।
ঢাকা, শেরেবাংলা নগর – সন্তান হত্যার পর আত্মহত্যা
এপ্রিল ২০২৪। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে মশিউর রহমান তার ছেলে সাদাবকে শ্বাসরোধে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেন। একইসঙ্গে তিনি মেয়ে সিনথিয়াকে হত্যার চেষ্টা করেন, তবে সে বেঁচে যায়। পারিবারিক বিরোধ ও মানসিক অবসাদ থেকে জন্ম নেওয়া এই ঘটনা ছিল এক গভীর ট্র্যাজেডি।
এখানে প্রশ্ন আসে—আমাদের সমাজে কি পর্যাপ্ত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা আছে? কীভাবে একজন পিতা এমন চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, যেখানে নিজের সন্তানকে হত্যা করাও হয়ে ওঠে মুক্তি পাওয়ার পথ?
পারিবারিক অন্ধকারের অন্তরালে
এই ঘটনাগুলোর পেছনে রয়েছে কিছু সাধারণ কারণ:
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা
পারিবারিক ও সামাজিক চাপ
সম্পত্তির দ্বন্দ্ব ও আর্থিক অনিশ্চয়তা
লিঙ্গবৈষম্য ও কুসংস্কার
অসহায়ত্বের চূড়ান্ত প্রকাশ
এগুলো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়; প্রতিটিই আমাদের সমাজের গভীর ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। মা যখন সন্তান হত্যা করেন, সেটা হয়তো তাৎক্ষণিক উন্মাদনা; কিন্তু সেই উন্মাদনার পেছনে থাকে এক অব্যক্ত আর্তনাদ—যা হয়তো কখনও শোনা হয়নি।
করণীয়
সবার আগে দরকার সচেতনতা। পরিবারে দ্বন্দ্ব দেখা দিলেই তা গোপন না রেখে কাউন্সেলিং নেওয়া উচিত।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য ও গ্রহণযোগ্য করতে হবে।
পারিবারিক শিক্ষার প্রয়োজন – যেখানে সম্মান, শ্রদ্ধা, সহনশীলতা শেখানো হয়।
মাদকবিরোধী কার্যক্রম আরও জোরদার করা উচিত।
উপসংহার
মা, বাবা, সন্তান – এই তিনটি নামই ভালোবাসার প্রতীক। কিন্তু সমাজে যে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে, তা আমাদের এই মুল্যবোধগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। পারিবারিক কাঠামোর এই ভাঙন ঠেকাতে হলে, আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে। শুধু আইন নয়, সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির জায়গা থেকেও সমাধান খুঁজতে হবে।
পরবর্তী পর্বে আমরা আলোচনা করব—এইসব অপরাধীদের ভবিষ্যৎ পরিণতি, বিচারব্যবস্থা এবং কীভাবে সমাজ এগিয়ে যেতে পারে এমন অন্ধকার সময় পার করে।
Tags:
Family Values Content