একজন ধনী রোগী সহজেই সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক চলে যেতে পারেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। অন্যদিকে, একজন গরিব বৃদ্ধ হাসপাতালের বারান্দায় দিনের পর দিন বসে থাকেন শুধুমাত্র এক টুকরো বেড কিংবা একটি ডাক্তার দেখার আশায়। এটাই কি স্বাস্থ্যসেবা? নাকি টাকার ভিত্তিতে বাঁচা-মরার অনুমতি?
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার বাস্তব চিত্রটি যেন এক নির্মম বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি। শহরে কর্পোরেট ক্লিনিকগুলোয় আধুনিক যন্ত্রপাতি আর বিশিষ্ট চিকিৎসক থাকলেও, গ্রামের ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওষুধ নেই, ডাক্তার নেই, নেই কোনো তদারকি। গরিব মানুষ আজ চিকিৎসার পরিবর্তে সহানুভূতির খোঁজে ফেরে।
এই প্রবন্ধে আমরা খুঁজে দেখব—স্বাস্থ্যসেবা কি সবার জন্য সমান, নাকি জীবন এখন শুধুই টাকার মাপে পরিমাপযোগ্য?
স্বাস্থ্যসেবা না বাণিজ্য: বাংলাদেশের চিকিৎসা বৈষম্যের এক নির্মোহ ব্যবচ্ছেদ
ভূমিকা: দুই জীবনের এক রোগ
কল্পনা করুন, মধ্য ঢাকার কোনো এক বস্তিতে বাস করেন রহিম শেখ। পঞ্চাশোর্ধ্ব রহিম সাহেব হঠাৎ বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন। পরিবারের লোকজন তাকে কোনোমতে ধরাধরি করে নিয়ে গেল নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে দীর্ঘ লাইন, রোগী ও স্বজনদের আর্তনাদ, আর ক্লান্ত-বিরক্ত চিকিৎসক-নার্সদের ছোটাছুটি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর তার জায়গা হলো ওয়ার্ডের মেঝেতে। ডাক্তার জানালেন, হার্ট অ্যাটাক। দ্রুত আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে, কিন্তু সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি নেই। শুরু হলো এক অসম যুদ্ধ।
একই দিনে, গুলশানের বাসিন্দা শিল্পপতি আনোয়ার চৌধুরী গলফ খেলতে গিয়ে বুকে অস্বস্তি বোধ করলেন। তার ব্যক্তিগত সহকারী তৎক্ষণাৎ ফোন করলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় এক কর্পোরেট হাসপাতালে। মিনিট দশেকের মধ্যে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির। সাইরেন বাজিয়ে গ্রিন করিডোর দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো সরাসরি কার্ডিয়াক ইউনিটে। সেখানে প্রস্তুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি দল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার অ্যাঞ্জিওগ্রাম সম্পন্ন হলো এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পর তাকে অত্যাধুনিক কেবিনে স্থানান্তর করা হলো।
রহিম শেখ এবং আনোয়ার চৌধুরী, দুজনেরই রোগ এক, কিন্তু তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হলো তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে। এই দৃশ্যটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটিই বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার রূঢ় বাস্তবতা। সংবিধান যেখানে স্বাস্থ্যসেবাকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেখানে এই খাতটি ধীরে ধীরে এক নির্লজ্জ বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্য এখন অধিকার নয়, বরং ক্রয়যোগ্য এক পণ্য। যার টাকা আছে, তার জন্য সিঙ্গাপুর-ব্যাংককের দরজা খোলা; আর যার নেই, তার জন্য সরকারি হাসপাতালের বারান্দা আর অন্তহীন অপেক্ষা।
এই পোস্টে আমরা বাংলাদেশের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের গভীরে প্রোথিত বৈষম্যের প্রতিটি স্তর উন্মোচন করার চেষ্টা করব। এটি কেবল একটি অভিযোগনামা নয়, বরং একটি গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ, যার উদ্দেশ্য এই অমানবিক বৈষম্যের কারণ, প্রভাব এবং সম্ভাব্য উত্তরণের পথ নিয়ে আলোচনা করা।
১. কাঁটাতারের দুই পার: ধনীদের বিদেশযাত্রা বনাম গরিবের সরকারি হাসপাতাল
স্বাস্থ্যসেবা বৈষম্যের সবচেয়ে নগ্ন রূপটি হলো চিকিৎসার জন্য রোগীদের ভৌগোলিক বিভাজন। বাংলাদেশের সচ্ছল এবং প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের সামান্য জটিল রোগের চিকিৎসার জন্যও আর দেশের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তাদের প্রথম পছন্দ ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা এমনকি ইউরোপ-আমেরিকা। এর পেছনে কারণগুলো স্পষ্ট:
আস্থার সংকট: দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা, বিশেষ করে রোগ নির্ণয় (Diagnosis) এবং চিকিৎসার ধারাবাহিকতার ওপর তাদের আস্থা নেই। ভুল চিকিৎসার অসংখ্য উদাহরণ এবং গণমাধ্যমের খবর এই আস্থাহীনতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
উন্নত প্রযুক্তি ও সেবা: বিদেশের হাসপাতালগুলোতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং উন্নত নার্সিং সেবা পাওয়া যায়, যা অনেক ক্ষেত্রেই দেশের সেরা হাসপাতালেও অনুপস্থিত।
ভিআইপি ট্রিটমেন্ট: বিদেশে তারা একজন ‘মূল্যবান গ্রাহক’ হিসেবে যে সম্মান ও মনোযোগ পান, দেশের ভিড়ে পরিপূর্ণ হাসপাতালে তা আশা করা যায় না।
এর ফলাফল কী? দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতি বছর চিকিৎসার নামে বিদেশে চলে যাচ্ছে, যা আমাদের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অন্যদিকে, দেশের সাধারণ মানুষ, যারা এই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, তাদের ভরসা সেই জীর্ণ, পুরাতন, এবং ভঙ্গুর সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।
সরকারি হাসপাতালের চিত্র:
একজন গরিব রোগীর জন্য সরকারি হাসপাতাল এক গোলকধাঁধার নাম। জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে ওয়ার্ডে একটি বেড পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপই এক একটি সংগ্রাম।
অন্তহীন অপেক্ষা: ডাক্তারের সিরিয়াল পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনওবা দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। একটি অপারেশনের তারিখ পেতে মাস বা বছরও পেরিয়ে যায়। এই দীর্ঘ অপেক্ষা একজন রোগীর শারীরিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তোলে।
সম্পদের সীমাবদ্ধতা: প্রয়োজনের তুলনায় ডাক্তার, নার্স, বেড, এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম—সবকিছুরই অভাব। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানেও দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে আসা রোগীর চাপ সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে, রোগীরা প্রায়শই মেঝেতে, করিডোরে বা সিঁড়ির নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
দালালদের দৌরাত্ম্য: হাসপাতালের প্রতিটি কোনায় ওঁৎ পেতে থাকে দালাল চক্র। একটি বেড পাইয়ে দেওয়া, দ্রুত ডাক্তারের সিরিয়াল দেওয়া বা টেস্টের রিপোর্ট আগে এনে দেওয়ার নাম করে তারা অসহায় রোগী ও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়।
এই চিত্রটি স্পষ্ট করে দেয় যে, রাষ্ট্র তার সকল নাগরিককে সমান স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা এখানে দুটি সমান্তরাল বিশ্বে বিভক্ত, যার একটি আলো ঝলমলে এবং অন্যটি অন্ধকারে নিমজ্জিত।
২. ওষুধের বাজার: দোকানভেদে দামের ফারাক ও অসহায় ক্রেতা
ওষুধ মানুষের জীবন বাঁচায়। কিন্তু এই জীবন রক্ষাকারী পণ্যটিও আজ মুনাফাখোরদের বাণিজ্যের অন্যতম হাতিয়ার। বাংলাদেশে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ অত্যন্ত দুর্বল।
এমআরপি (MRP) নিয়ে কারসাজি: প্রায় প্রতিটি ওষুধের প্যাকেজেই সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (Maximum Retail Price) লেখা থাকে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, অনেক কোম্পানি উৎপাদন খরচের চেয়ে বহুগুণ বেশি এমআরপি নির্ধারণ করে। এরপর সেই দামের ওপর ফার্মেসিগুলোকে বড় অঙ্কের কমিশন দেওয়া হয়। ফলে, বিভিন্ন দোকানে একই ওষুধ ভিন্ন ভিন্ন ছাড়ে বিক্রি হয়। বড়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ফার্মেসিগুলো যেখানে ১০-১২% ছাড় দেয়, সেখানে গরিবের আশ্রয়স্থল লোকাল ফার্মেসিগুলো হয়ত কোনো ছাড়ই দেয় না, বা দিলেও তা যৎসামান্য।
ব্র্যান্ড বনাম জেনেরিক: ডাক্তাররা প্রায়শই নির্দিষ্ট কোম্পানির ব্র্যান্ডের ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। এর পেছনে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের বিভিন্ন উপঢৌকন ও সুযোগ-সুবিধার প্রভাব রয়েছে বলে অভিযোগ শোনা যায়। একই জেনেরিকের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ওষুধের দামের মধ্যেও ব্যাপক পার্থক্য থাকে। একজন সাধারণ রোগী বা তার পরিবারের পক্ষে এই পার্থক্য বোঝা এবং কম দামের জেনেরিক ওষুধ বেছে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে, তারা ডাক্তারের লিখে দেওয়া দামী ব্র্যান্ডের ওষুধ কিনতেই বাধ্য হন।
নকল ও নিম্নমানের ওষুধ: ছোট, অখ্যাত এবং লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসিগুলোতে নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ এবং নিম্নমানের ওষুধের রমরমা ব্যবসা চলে। গরিব এবং স্বল্পশিক্ষিত মানুষ, যারা সাধারণত এসব ফার্মেসির ওপর নির্ভরশীল, তারাই এর প্রধান শিকার। এতে একদিকে যেমন তাদের অর্থ নষ্ট হয়, তেমনি অন্যদিকে ভুল চিকিৎসায় তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
এই অনিয়ন্ত্রিত ওষুধের বাজার গরিব রোগীদের জন্য একটি নীরব ঘাতক। একদিকে তাদের দামী ওষুধ কিনতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতে হয়, অন্যদিকে নকল ওষুধের কারণে জীবন বিপন্ন হয়।
৩. ভৌগোলিক বিভাজন: শহরে আধুনিক হাসপাতাল, গ্রামে ডাক্তারশূন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র
"গ্রামের মানুষ শহরের তুলনায় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত"—এই কথাটি এখন একটি ক্লিশেতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এর পেছনের বাস্তবতা অত্যন্ত ভয়াবহ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চরমভাবে শহরকেন্দ্রিক, বিশেষ করে ঢাকাকেন্দ্রিক।
শহরের চিত্র:
ঢাকা, চট্টগ্রাম বা সিলেটের মতো বড় শহরগুলোতে রয়েছে পাঁচ তারকা মানের কর্পোরেট হাসপাতাল। ঝকঝকে ভবন, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, বিদেশী ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক—কী নেই সেখানে! এই হাসপাতালগুলো মূলত দেশের উচ্চবিত্ত এবং ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্তকে লক্ষ্য করে তৈরি। তাদের সেবা নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের, কিন্তু তার মূল্য সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গ্রামের চিত্র:
বিপরীতে, গ্রামের চিত্র হতাশাজনক। সরকার তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেছে। কাগজে-কলমে এই কাঠামোটি চমৎকার। কিন্তু বাস্তবে?
ডাক্তার সংকট: উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তারদের নিয়োগ দেওয়া হলেও তাদের একটি বড় অংশই সেখানে থাকতে চান না। উন্নত জীবনযাত্রা, সন্তানদের ভালো স্কুলে পড়ানো, এবং প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগের জন্য তারা যে কোনো উপায়ে শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় বদলি হওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে, গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো প্রায়শই ডাক্তারশূন্য থাকে এবং সেগুলোর দায়িত্ব পালন করেন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ফার্মাসিস্টরা।
সরঞ্জামের অভাব: এক্স-রে মেশিন থাকলেও টেকনিশিয়ান নেই, অপারেশন থিয়েটার থাকলেও সার্জন বা অ্যানেসথেটিস্ট নেই, প্যাথলজি ল্যাব থাকলেও প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট নেই—এই হলো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর সাধারণ চিত্র। ফলে, সামান্য জটিল কোনো কেস এলেই রোগীদের "রেফার" করে দেওয়া হয় জেলা বা বিভাগীয় শহরের হাসপাতালে।
অবকাঠামোগত দুর্বলতা: অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভবন জরাজীর্ণ, বিদ্যুৎ বা পানির সঠিক ব্যবস্থা নেই। অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও তা ব্যবহারের অনুপযোগী। এই পরিবেশে রোগীরা যেমন মানসম্মত সেবা পান না, তেমনি স্বাস্থ্যকর্মীরাও কাজ করার অনুপ্রেরণা হারিয়ে ফেলেন।
এই শহর-গ্রামের বৈষম্য শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসেবাকেই পঙ্গু করছে না, বরং এটি সার্বিক গ্রামীন উন্নয়নকেও বাধাগ্রস্ত করছে। একজন অসুস্থ মানুষ বা তার পরিবার যখন চিকিৎসার জন্য শহরে ছুটতে বাধ্য হয়, তখন তার কৃষি বা অন্য পেশার কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা তাদের দারিদ্র্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
৪. জীবনের নিলাম: অপারেশন ও আইসিইউ বেডের অগ্রাধিকার
জরুরি মুহূর্তে একটি আইসিইউ বেড বা একটি অপারেশনের তারিখ একজন রোগীর জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। দুঃখজনকভাবে, এই জীবন রক্ষাকারী সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও অর্থ এবং ক্ষমতাই প্রধান মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইসিইউ বাণিজ্য: সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেডের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। একটি বেড খালি হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন অসংখ্য মুমূর্ষু রোগী। এই সুযোগে প্রাইভেট হাসপাতালগুলো আইসিইউ সেবাকে এক লাভজনক বাণিজ্যে পরিণত করেছে। তাদের আইসিইউ-এর দৈনিক ভাড়া এতটাই বেশি যে, তা সাধারণ মানুষের কল্পনারও বাইরে। একজন গরিব রোগীর পরিবার জমিজমা বিক্রি করেও কয়েক দিনের বেশি আইসিইউ-এর খরচ চালাতে পারে না।
ক্ষমতার খেলা: প্রায়শই দেখা যায়, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বা বিত্তশালী কোনো ব্যক্তির জন্য আইসিইউ বেড বা অপারেশনের তারিখ খুব সহজেই ব্যবস্থা হয়ে যায়। অন্যদিকে, কোনো সাধারণ রোগী হয়তো দীর্ঘ অপেক্ষার পর বিনা চিকিৎসায়ই মারা যান। এই অদৃশ্য "অগ্রাধিকার" এর কোনো লিখিত নিয়ম নেই, কিন্তু এটিই স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে বড় ওপেন সিক্রেট।
"রেফার" সংস্কৃতি: সরকারি হাসপাতালগুলো সক্ষমতার অভাবের কারণে প্রায়শই জটিল রোগীদের প্রাইভেট হাসপাতালে "রেফার" করে। এটি একদিকে যেমন তাদের দায় এড়ানোর একটি কৌশল, তেমনি অন্যদিকে এর মাধ্যমে একটি অসাধু চক্র প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে কমিশন লাভ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। অসহায় রোগীর পরিবার তখন কোনো উপায় না দেখে ঋণ করে বা শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে প্রাইভেট হাসপাতালের দামী চিকিৎসার ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হয়।
যখন একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর সিদ্ধান্ত তার চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তার চেয়ে তার আর্থিক সক্ষমতার ওপর বেশি নির্ভর করে, তখন বুঝতে হবে সমাজ হিসেবে আমরা নৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছি।
৫. নিয়ন্ত্রণহীন প্রাইভেট খাত: সেবার নামে প্রতারণার ফাঁদ
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের একটি বড় অংশ এখন প্রাইভেট বা বেসরকারি খাতের দখলে। শহর থেকে শুরু করে মফস্বল পর্যন্ত গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং হাসপাতাল। এই খাতের বৃদ্ধি একদিকে যেমন স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা বাড়িয়েছে, তেমনি অন্যদিকে এটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এক প্রতারণার আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
অপ্রয়োজনীয় টেস্টের বোঝা: প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গেলেই একগাদা মেডিকেল টেস্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়, যার অনেকগুলোই হয়তো অপ্রয়োজনীয়। অভিযোগ আছে, অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে ডাক্তারদের কমিশনভিত্তিক চুক্তি থাকে। যত বেশি টেস্ট, তত বেশি কমিশন। এই অনৈতিক চক্রের শিকার হন সাধারণ রোগীরা।
বিল নিয়ে কারচুপি: চিকিৎসা শেষে যখন বিলের কাগজ হাতে আসে, তখন অনেক রোগীর পরিবারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বিভিন্ন অস্পষ্ট ও অস্বচ্ছ খাতে পরিমাণ চার্জ যুক্ত করা হয়। বেড ভাড়া, সার্ভিস চার্জ, নার্সিং চার্জ, ডাক্তারের ভিজিট—প্রতিটি খাতেই বিলকে স্ফীত করার প্রবণতা দেখা যায়।
চিকিৎসায় অবহেলা ও ভুল চিকিৎসা: অনেক প্রাইভেট ক্লিনিকেরই মানসম্মত চিকিৎসক, নার্স বা প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। শুধুমাত্র মুনাফার লোভে তারা এমন সব জটিল রোগের চিকিৎসা বা অপারেশন করে, যার সক্ষমতা তাদের নেই। ফলে, ভুল চিকিৎসা বা অবহেলায় রোগীর মৃত্যু বা অঙ্গহানির মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা: এই অনিয়মগুলো দেখার দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (DGHS) এর। কিন্তু তাদের জনবল সংকট, দুর্নীতির অভিযোগ এবং রাজনৈতিক চাপের কারণে তারা কার্যকরভাবে এই বেসরকারি খাতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মাঝে মাঝে কিছু অভিযান চালানো হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। ফলে, প্রতারক চক্র নির্ভয়ে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
উপসংহার ও উত্তরণের পথ: শুধু প্রতিবাদ নয়, চাই প্রতিরোধ
উপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা একটি গভীর সংকট ও বৈষম্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটি এখন আর শুধু সেবামূলক খাত নয়, বরং এটি একটি বিশাল শিল্প, যেখানে মুনাফাই মূল লক্ষ্য। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের একটি বহুমুখী এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এটি শুধু সরকারের একার কাজ নয়, এখানে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম এবং প্রতিটি সচেতন নাগরিকের ভূমিকা রয়েছে।
করণীয় কী হতে পারে?
১. সরকারি স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি: জিডিপির অনুপাতে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সর্বনিম্ন। এই বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে হবে। নতুন হাসপাতাল নির্মাণ, পুরাতনগুলোর আধুনিকায়ন, যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
২. গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালীকরণ: গ্রামে ডাক্তারদের ধরে রাখার জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ (যেমন: উচ্চতর বেতন, আবাসন সুবিধা, সন্তানদের জন্য ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্যারিয়ারে অগ্রাধিকার) চালু করতে হবে। ইউনিয়ন এবং উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে সত্যিকারের কার্যকর ফার্স্ট পয়েন্ট অফ কন্টাক্ট হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
৩. প্রাইভেট খাতের কঠোর নিয়ন্ত্রণ: প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর জন্য একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। চিকিৎসার খরচ নির্ধারণ, বিলিং সিস্টেম এবং সেবার মান নিরীক্ষণের জন্য একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী রেগুলেটরি কমিশন গঠন করা যেতে পারে। ভুল চিকিৎসার জন্য কঠোর শাস্তি এবং রোগীদের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৪. সার্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা প্রবর্তন: দেশের সকল নাগরিককে, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষকে, একটি সার্বজনীন স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে একজন নাগরিক তার আর্থিক অবস্থা নির্বিশেষে মানসম্মত চিকিৎসা সেবা পেতে পারেন।
৫. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: রোগীর অধিকার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে। ওষুধের জেনেরিক নাম, চিকিৎসার খরচ এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে তথ্য জানার অধিকার তাদের রয়েছে। গণমাধ্যম এই সচেতনতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
শেষ কথা হলো, স্বাস্থ্য কোনো বিলাসিতা নয়, এটি মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। একটি দেশের সভ্যতার পরিমাপ হয় তার সবচেয়ে দুর্বল মানুষটির সাথে করা আচরণের মাধ্যমে। আনোয়ার চৌধুরী যে মানের সেবা অর্থের বিনিময়ে পাচ্ছেন, রহিম শেখের সেই মানের সেবা অধিকার হিসেবে পাওয়ার কথা। সেই সমতার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আমাদের সম্মিলিত আওয়াজ তুলতে হবে। শুধু প্রতিবাদ করলে হবে না, এই বাণিজ্যিকীকরণ এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নতুবা, স্বাস্থ্যসেবার এই বাজার হাজারো রহিম শেখের জীবনকে গ্রাস করতে থাকবে, আর আমরা একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও মধ্যযুগীয় অসাম্যের দর্শক হয়েই থেকে যাব।
স্বাস্থ্যসেবা বৈষম্য ও চিকিৎসা সংকট | কল্পকথা৩৬০
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার বাস্তব চিত্রটি যেন এক নির্মম বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি। শহরে কর্পোরেট ক্লিনিকগুলোয় আধুনিক যন্ত্রপাতি আর বিশিষ্ট চিকিৎসক থাকলেও, গ্রামের ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওষুধ নেই, ডাক্তার নেই, নেই কোনো তদারকি। গরিব মানুষ আজ চিকিৎসার পরিবর্তে সহানুভূতির খোঁজে ফেরে।
এই প্রবন্ধে আমরা খুঁজে দেখব—স্বাস্থ্যসেবা কি সবার জন্য সমান, নাকি জীবন এখন শুধুই টাকার মাপে পরিমাপযোগ্য?
স্বাস্থ্যসেবা না বাণিজ্য: বাংলাদেশের চিকিৎসা বৈষম্যের এক নির্মোহ ব্যবচ্ছেদ
ভূমিকা: দুই জীবনের এক রোগ
কল্পনা করুন, মধ্য ঢাকার কোনো এক বস্তিতে বাস করেন রহিম শেখ। পঞ্চাশোর্ধ্ব রহিম সাহেব হঠাৎ বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন। পরিবারের লোকজন তাকে কোনোমতে ধরাধরি করে নিয়ে গেল নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে দীর্ঘ লাইন, রোগী ও স্বজনদের আর্তনাদ, আর ক্লান্ত-বিরক্ত চিকিৎসক-নার্সদের ছোটাছুটি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর তার জায়গা হলো ওয়ার্ডের মেঝেতে। ডাক্তার জানালেন, হার্ট অ্যাটাক। দ্রুত আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে, কিন্তু সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি নেই। শুরু হলো এক অসম যুদ্ধ।
একই দিনে, গুলশানের বাসিন্দা শিল্পপতি আনোয়ার চৌধুরী গলফ খেলতে গিয়ে বুকে অস্বস্তি বোধ করলেন। তার ব্যক্তিগত সহকারী তৎক্ষণাৎ ফোন করলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় এক কর্পোরেট হাসপাতালে। মিনিট দশেকের মধ্যে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির। সাইরেন বাজিয়ে গ্রিন করিডোর দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো সরাসরি কার্ডিয়াক ইউনিটে। সেখানে প্রস্তুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি দল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার অ্যাঞ্জিওগ্রাম সম্পন্ন হলো এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পর তাকে অত্যাধুনিক কেবিনে স্থানান্তর করা হলো।
রহিম শেখ এবং আনোয়ার চৌধুরী, দুজনেরই রোগ এক, কিন্তু তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হলো তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে। এই দৃশ্যটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটিই বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার রূঢ় বাস্তবতা। সংবিধান যেখানে স্বাস্থ্যসেবাকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেখানে এই খাতটি ধীরে ধীরে এক নির্লজ্জ বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্য এখন অধিকার নয়, বরং ক্রয়যোগ্য এক পণ্য। যার টাকা আছে, তার জন্য সিঙ্গাপুর-ব্যাংককের দরজা খোলা; আর যার নেই, তার জন্য সরকারি হাসপাতালের বারান্দা আর অন্তহীন অপেক্ষা।
এই পোস্টে আমরা বাংলাদেশের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের গভীরে প্রোথিত বৈষম্যের প্রতিটি স্তর উন্মোচন করার চেষ্টা করব। এটি কেবল একটি অভিযোগনামা নয়, বরং একটি গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ, যার উদ্দেশ্য এই অমানবিক বৈষম্যের কারণ, প্রভাব এবং সম্ভাব্য উত্তরণের পথ নিয়ে আলোচনা করা।
১. কাঁটাতারের দুই পার: ধনীদের বিদেশযাত্রা বনাম গরিবের সরকারি হাসপাতাল
স্বাস্থ্যসেবা বৈষম্যের সবচেয়ে নগ্ন রূপটি হলো চিকিৎসার জন্য রোগীদের ভৌগোলিক বিভাজন। বাংলাদেশের সচ্ছল এবং প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের সামান্য জটিল রোগের চিকিৎসার জন্যও আর দেশের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তাদের প্রথম পছন্দ ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা এমনকি ইউরোপ-আমেরিকা। এর পেছনে কারণগুলো স্পষ্ট:
আস্থার সংকট: দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা, বিশেষ করে রোগ নির্ণয় (Diagnosis) এবং চিকিৎসার ধারাবাহিকতার ওপর তাদের আস্থা নেই। ভুল চিকিৎসার অসংখ্য উদাহরণ এবং গণমাধ্যমের খবর এই আস্থাহীনতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
উন্নত প্রযুক্তি ও সেবা: বিদেশের হাসপাতালগুলোতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং উন্নত নার্সিং সেবা পাওয়া যায়, যা অনেক ক্ষেত্রেই দেশের সেরা হাসপাতালেও অনুপস্থিত।
ভিআইপি ট্রিটমেন্ট: বিদেশে তারা একজন ‘মূল্যবান গ্রাহক’ হিসেবে যে সম্মান ও মনোযোগ পান, দেশের ভিড়ে পরিপূর্ণ হাসপাতালে তা আশা করা যায় না।
এর ফলাফল কী? দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতি বছর চিকিৎসার নামে বিদেশে চলে যাচ্ছে, যা আমাদের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অন্যদিকে, দেশের সাধারণ মানুষ, যারা এই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, তাদের ভরসা সেই জীর্ণ, পুরাতন, এবং ভঙ্গুর সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।
সরকারি হাসপাতালের চিত্র:
একজন গরিব রোগীর জন্য সরকারি হাসপাতাল এক গোলকধাঁধার নাম। জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে ওয়ার্ডে একটি বেড পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপই এক একটি সংগ্রাম।
অন্তহীন অপেক্ষা: ডাক্তারের সিরিয়াল পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনওবা দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। একটি অপারেশনের তারিখ পেতে মাস বা বছরও পেরিয়ে যায়। এই দীর্ঘ অপেক্ষা একজন রোগীর শারীরিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তোলে।
সম্পদের সীমাবদ্ধতা: প্রয়োজনের তুলনায় ডাক্তার, নার্স, বেড, এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম—সবকিছুরই অভাব। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানেও দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে আসা রোগীর চাপ সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে, রোগীরা প্রায়শই মেঝেতে, করিডোরে বা সিঁড়ির নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
দালালদের দৌরাত্ম্য: হাসপাতালের প্রতিটি কোনায় ওঁৎ পেতে থাকে দালাল চক্র। একটি বেড পাইয়ে দেওয়া, দ্রুত ডাক্তারের সিরিয়াল দেওয়া বা টেস্টের রিপোর্ট আগে এনে দেওয়ার নাম করে তারা অসহায় রোগী ও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়।
এই চিত্রটি স্পষ্ট করে দেয় যে, রাষ্ট্র তার সকল নাগরিককে সমান স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা এখানে দুটি সমান্তরাল বিশ্বে বিভক্ত, যার একটি আলো ঝলমলে এবং অন্যটি অন্ধকারে নিমজ্জিত।
২. ওষুধের বাজার: দোকানভেদে দামের ফারাক ও অসহায় ক্রেতা
ওষুধ মানুষের জীবন বাঁচায়। কিন্তু এই জীবন রক্ষাকারী পণ্যটিও আজ মুনাফাখোরদের বাণিজ্যের অন্যতম হাতিয়ার। বাংলাদেশে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ অত্যন্ত দুর্বল।
এমআরপি (MRP) নিয়ে কারসাজি: প্রায় প্রতিটি ওষুধের প্যাকেজেই সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (Maximum Retail Price) লেখা থাকে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, অনেক কোম্পানি উৎপাদন খরচের চেয়ে বহুগুণ বেশি এমআরপি নির্ধারণ করে। এরপর সেই দামের ওপর ফার্মেসিগুলোকে বড় অঙ্কের কমিশন দেওয়া হয়। ফলে, বিভিন্ন দোকানে একই ওষুধ ভিন্ন ভিন্ন ছাড়ে বিক্রি হয়। বড়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ফার্মেসিগুলো যেখানে ১০-১২% ছাড় দেয়, সেখানে গরিবের আশ্রয়স্থল লোকাল ফার্মেসিগুলো হয়ত কোনো ছাড়ই দেয় না, বা দিলেও তা যৎসামান্য।
ব্র্যান্ড বনাম জেনেরিক: ডাক্তাররা প্রায়শই নির্দিষ্ট কোম্পানির ব্র্যান্ডের ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। এর পেছনে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের বিভিন্ন উপঢৌকন ও সুযোগ-সুবিধার প্রভাব রয়েছে বলে অভিযোগ শোনা যায়। একই জেনেরিকের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ওষুধের দামের মধ্যেও ব্যাপক পার্থক্য থাকে। একজন সাধারণ রোগী বা তার পরিবারের পক্ষে এই পার্থক্য বোঝা এবং কম দামের জেনেরিক ওষুধ বেছে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে, তারা ডাক্তারের লিখে দেওয়া দামী ব্র্যান্ডের ওষুধ কিনতেই বাধ্য হন।
নকল ও নিম্নমানের ওষুধ: ছোট, অখ্যাত এবং লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসিগুলোতে নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ এবং নিম্নমানের ওষুধের রমরমা ব্যবসা চলে। গরিব এবং স্বল্পশিক্ষিত মানুষ, যারা সাধারণত এসব ফার্মেসির ওপর নির্ভরশীল, তারাই এর প্রধান শিকার। এতে একদিকে যেমন তাদের অর্থ নষ্ট হয়, তেমনি অন্যদিকে ভুল চিকিৎসায় তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
এই অনিয়ন্ত্রিত ওষুধের বাজার গরিব রোগীদের জন্য একটি নীরব ঘাতক। একদিকে তাদের দামী ওষুধ কিনতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতে হয়, অন্যদিকে নকল ওষুধের কারণে জীবন বিপন্ন হয়।
৩. ভৌগোলিক বিভাজন: শহরে আধুনিক হাসপাতাল, গ্রামে ডাক্তারশূন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র
"গ্রামের মানুষ শহরের তুলনায় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত"—এই কথাটি এখন একটি ক্লিশেতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এর পেছনের বাস্তবতা অত্যন্ত ভয়াবহ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চরমভাবে শহরকেন্দ্রিক, বিশেষ করে ঢাকাকেন্দ্রিক।
শহরের চিত্র:
ঢাকা, চট্টগ্রাম বা সিলেটের মতো বড় শহরগুলোতে রয়েছে পাঁচ তারকা মানের কর্পোরেট হাসপাতাল। ঝকঝকে ভবন, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, বিদেশী ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক—কী নেই সেখানে! এই হাসপাতালগুলো মূলত দেশের উচ্চবিত্ত এবং ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্তকে লক্ষ্য করে তৈরি। তাদের সেবা নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের, কিন্তু তার মূল্য সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গ্রামের চিত্র:
বিপরীতে, গ্রামের চিত্র হতাশাজনক। সরকার তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেছে। কাগজে-কলমে এই কাঠামোটি চমৎকার। কিন্তু বাস্তবে?
ডাক্তার সংকট: উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তারদের নিয়োগ দেওয়া হলেও তাদের একটি বড় অংশই সেখানে থাকতে চান না। উন্নত জীবনযাত্রা, সন্তানদের ভালো স্কুলে পড়ানো, এবং প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগের জন্য তারা যে কোনো উপায়ে শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় বদলি হওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে, গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো প্রায়শই ডাক্তারশূন্য থাকে এবং সেগুলোর দায়িত্ব পালন করেন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ফার্মাসিস্টরা।
সরঞ্জামের অভাব: এক্স-রে মেশিন থাকলেও টেকনিশিয়ান নেই, অপারেশন থিয়েটার থাকলেও সার্জন বা অ্যানেসথেটিস্ট নেই, প্যাথলজি ল্যাব থাকলেও প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট নেই—এই হলো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর সাধারণ চিত্র। ফলে, সামান্য জটিল কোনো কেস এলেই রোগীদের "রেফার" করে দেওয়া হয় জেলা বা বিভাগীয় শহরের হাসপাতালে।
অবকাঠামোগত দুর্বলতা: অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভবন জরাজীর্ণ, বিদ্যুৎ বা পানির সঠিক ব্যবস্থা নেই। অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও তা ব্যবহারের অনুপযোগী। এই পরিবেশে রোগীরা যেমন মানসম্মত সেবা পান না, তেমনি স্বাস্থ্যকর্মীরাও কাজ করার অনুপ্রেরণা হারিয়ে ফেলেন।
এই শহর-গ্রামের বৈষম্য শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসেবাকেই পঙ্গু করছে না, বরং এটি সার্বিক গ্রামীন উন্নয়নকেও বাধাগ্রস্ত করছে। একজন অসুস্থ মানুষ বা তার পরিবার যখন চিকিৎসার জন্য শহরে ছুটতে বাধ্য হয়, তখন তার কৃষি বা অন্য পেশার কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা তাদের দারিদ্র্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
৪. জীবনের নিলাম: অপারেশন ও আইসিইউ বেডের অগ্রাধিকার
জরুরি মুহূর্তে একটি আইসিইউ বেড বা একটি অপারেশনের তারিখ একজন রোগীর জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। দুঃখজনকভাবে, এই জীবন রক্ষাকারী সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও অর্থ এবং ক্ষমতাই প্রধান মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইসিইউ বাণিজ্য: সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেডের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। একটি বেড খালি হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন অসংখ্য মুমূর্ষু রোগী। এই সুযোগে প্রাইভেট হাসপাতালগুলো আইসিইউ সেবাকে এক লাভজনক বাণিজ্যে পরিণত করেছে। তাদের আইসিইউ-এর দৈনিক ভাড়া এতটাই বেশি যে, তা সাধারণ মানুষের কল্পনারও বাইরে। একজন গরিব রোগীর পরিবার জমিজমা বিক্রি করেও কয়েক দিনের বেশি আইসিইউ-এর খরচ চালাতে পারে না।
ক্ষমতার খেলা: প্রায়শই দেখা যায়, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বা বিত্তশালী কোনো ব্যক্তির জন্য আইসিইউ বেড বা অপারেশনের তারিখ খুব সহজেই ব্যবস্থা হয়ে যায়। অন্যদিকে, কোনো সাধারণ রোগী হয়তো দীর্ঘ অপেক্ষার পর বিনা চিকিৎসায়ই মারা যান। এই অদৃশ্য "অগ্রাধিকার" এর কোনো লিখিত নিয়ম নেই, কিন্তু এটিই স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে বড় ওপেন সিক্রেট।
"রেফার" সংস্কৃতি: সরকারি হাসপাতালগুলো সক্ষমতার অভাবের কারণে প্রায়শই জটিল রোগীদের প্রাইভেট হাসপাতালে "রেফার" করে। এটি একদিকে যেমন তাদের দায় এড়ানোর একটি কৌশল, তেমনি অন্যদিকে এর মাধ্যমে একটি অসাধু চক্র প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে কমিশন লাভ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। অসহায় রোগীর পরিবার তখন কোনো উপায় না দেখে ঋণ করে বা শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে প্রাইভেট হাসপাতালের দামী চিকিৎসার ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হয়।
যখন একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর সিদ্ধান্ত তার চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তার চেয়ে তার আর্থিক সক্ষমতার ওপর বেশি নির্ভর করে, তখন বুঝতে হবে সমাজ হিসেবে আমরা নৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছি।
৫. নিয়ন্ত্রণহীন প্রাইভেট খাত: সেবার নামে প্রতারণার ফাঁদ
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের একটি বড় অংশ এখন প্রাইভেট বা বেসরকারি খাতের দখলে। শহর থেকে শুরু করে মফস্বল পর্যন্ত গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং হাসপাতাল। এই খাতের বৃদ্ধি একদিকে যেমন স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা বাড়িয়েছে, তেমনি অন্যদিকে এটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এক প্রতারণার আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
অপ্রয়োজনীয় টেস্টের বোঝা: প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গেলেই একগাদা মেডিকেল টেস্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়, যার অনেকগুলোই হয়তো অপ্রয়োজনীয়। অভিযোগ আছে, অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে ডাক্তারদের কমিশনভিত্তিক চুক্তি থাকে। যত বেশি টেস্ট, তত বেশি কমিশন। এই অনৈতিক চক্রের শিকার হন সাধারণ রোগীরা।
বিল নিয়ে কারচুপি: চিকিৎসা শেষে যখন বিলের কাগজ হাতে আসে, তখন অনেক রোগীর পরিবারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বিভিন্ন অস্পষ্ট ও অস্বচ্ছ খাতে পরিমাণ চার্জ যুক্ত করা হয়। বেড ভাড়া, সার্ভিস চার্জ, নার্সিং চার্জ, ডাক্তারের ভিজিট—প্রতিটি খাতেই বিলকে স্ফীত করার প্রবণতা দেখা যায়।
চিকিৎসায় অবহেলা ও ভুল চিকিৎসা: অনেক প্রাইভেট ক্লিনিকেরই মানসম্মত চিকিৎসক, নার্স বা প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। শুধুমাত্র মুনাফার লোভে তারা এমন সব জটিল রোগের চিকিৎসা বা অপারেশন করে, যার সক্ষমতা তাদের নেই। ফলে, ভুল চিকিৎসা বা অবহেলায় রোগীর মৃত্যু বা অঙ্গহানির মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা: এই অনিয়মগুলো দেখার দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (DGHS) এর। কিন্তু তাদের জনবল সংকট, দুর্নীতির অভিযোগ এবং রাজনৈতিক চাপের কারণে তারা কার্যকরভাবে এই বেসরকারি খাতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মাঝে মাঝে কিছু অভিযান চালানো হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। ফলে, প্রতারক চক্র নির্ভয়ে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
উপসংহার ও উত্তরণের পথ: শুধু প্রতিবাদ নয়, চাই প্রতিরোধ
উপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা একটি গভীর সংকট ও বৈষম্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটি এখন আর শুধু সেবামূলক খাত নয়, বরং এটি একটি বিশাল শিল্প, যেখানে মুনাফাই মূল লক্ষ্য। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের একটি বহুমুখী এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এটি শুধু সরকারের একার কাজ নয়, এখানে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম এবং প্রতিটি সচেতন নাগরিকের ভূমিকা রয়েছে।
করণীয় কী হতে পারে?
১. সরকারি স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি: জিডিপির অনুপাতে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সর্বনিম্ন। এই বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে হবে। নতুন হাসপাতাল নির্মাণ, পুরাতনগুলোর আধুনিকায়ন, যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
২. গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালীকরণ: গ্রামে ডাক্তারদের ধরে রাখার জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ (যেমন: উচ্চতর বেতন, আবাসন সুবিধা, সন্তানদের জন্য ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্যারিয়ারে অগ্রাধিকার) চালু করতে হবে। ইউনিয়ন এবং উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে সত্যিকারের কার্যকর ফার্স্ট পয়েন্ট অফ কন্টাক্ট হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
৩. প্রাইভেট খাতের কঠোর নিয়ন্ত্রণ: প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর জন্য একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। চিকিৎসার খরচ নির্ধারণ, বিলিং সিস্টেম এবং সেবার মান নিরীক্ষণের জন্য একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী রেগুলেটরি কমিশন গঠন করা যেতে পারে। ভুল চিকিৎসার জন্য কঠোর শাস্তি এবং রোগীদের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৪. সার্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা প্রবর্তন: দেশের সকল নাগরিককে, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষকে, একটি সার্বজনীন স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে একজন নাগরিক তার আর্থিক অবস্থা নির্বিশেষে মানসম্মত চিকিৎসা সেবা পেতে পারেন।
৫. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: রোগীর অধিকার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে। ওষুধের জেনেরিক নাম, চিকিৎসার খরচ এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে তথ্য জানার অধিকার তাদের রয়েছে। গণমাধ্যম এই সচেতনতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
শেষ কথা হলো, স্বাস্থ্য কোনো বিলাসিতা নয়, এটি মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। একটি দেশের সভ্যতার পরিমাপ হয় তার সবচেয়ে দুর্বল মানুষটির সাথে করা আচরণের মাধ্যমে। আনোয়ার চৌধুরী যে মানের সেবা অর্থের বিনিময়ে পাচ্ছেন, রহিম শেখের সেই মানের সেবা অধিকার হিসেবে পাওয়ার কথা। সেই সমতার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আমাদের সম্মিলিত আওয়াজ তুলতে হবে। শুধু প্রতিবাদ করলে হবে না, এই বাণিজ্যিকীকরণ এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নতুবা, স্বাস্থ্যসেবার এই বাজার হাজারো রহিম শেখের জীবনকে গ্রাস করতে থাকবে, আর আমরা একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও মধ্যযুগীয় অসাম্যের দর্শক হয়েই থেকে যাব।