মুসলিম দেশের সম্পদ দখলের লড়াই: ভূ-রাজনীতি ও সন্ত্রাসবাদ নাটক

মুসলিম বিশ্বের সম্পদ: ভূ-রাজনৈতিক লোভ, ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার এবং 'সন্ত্রাসবাদ' আখ্যানের আড়ালে

মুসলিম দেশ, খনিজ সম্পদ, তেল, গ্যাস, ভূ-রাজনীতি, উপনিবেশ, সন্ত্রাসবাদ, মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ইউরোপ, সম্পদ শোষণ, জ্বালানি নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, গবেষণা ব্লগ পোস্ট, মুসলিম বিশ্বের সম্পদ, ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত, ঔপনিবেশিক প্রভাব, সন্ত্রাসবাদের আখ্যান।   


বিবরণ: মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য কীভাবে বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামো এবং ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, এই গবেষণা-ভিত্তিক ব্লগ পোস্টে তার গভীর বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, পরাশক্তিদের কৌশলগত স্বার্থ, এবং 'সন্ত্রাসবাদ' আখ্যানের সম্ভাব্য অপব্যবহারের মাধ্যমে মুসলিম দেশগুলোর সম্পদ শোষণ ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জটিল প্রক্রিয়া উন্মোচন করা হয়েছে।

১. ভূমিকা: মুসলিম বিশ্বের সম্পদের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব

মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা (MENA) অঞ্চল, প্রাকৃতিক সম্পদের এক বিশাল ভান্ডার। এই অঞ্চল বিশ্বের বৃহত্তম পেট্রোলিয়াম (৫৫% প্রমাণিত রিজার্ভ) এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের (৩২% রিজার্ভ) মজুদের অধিকারী। মরক্কো একাই বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি ফসফেট ধারণ করে । এই বিপুল সম্পদ বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে এই অঞ্চলের অপরিহার্যতা নিশ্চিত করেছে। ২০১৯ সালে, MENA অঞ্চল বিশ্বের অপরিশোধিত পেট্রোলিয়ামের ৩৭.০%, প্রাকৃতিক গ্যাসের ২১.০% এবং পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্যের ১০.২% উৎপাদন করেছে । সৌদি আরব (১১.৮% বিশ্ব উৎপাদন) এবং ইরান (৬.২% বিশ্ব উৎপাদন) যথাক্রমে অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের শীর্ষ উৎপাদকদের মধ্যে অন্যতম ।

তেল ও গ্যাস ছাড়াও, এই অঞ্চলে স্বর্ণ, বক্সাইট, দস্তা, তামা, আয়রন আকরিক, ফসফেট, লিথিয়াম, ইউরেনিয়াম, এবং ম্যাঙ্গানিজের মতো অন্যান্য মূল্যবান খনিজ সম্পদ রয়েছে, যার অনেকগুলো এখনও অনাবিষ্কৃত বা স্বল্প-অনুসন্ধানকৃত । উদাহরণস্বরূপ, আফগানিস্তানে ১,৪০০ টিরও বেশি খনিজ ক্ষেত্র রয়েছে, যার মূল্য ১ থেকে ৩ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে, এবং এটিকে "লিথিয়ামের সৌদি আরব" বলা হয় । আধুনিক প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় লিথিয়াম এবং বিরল মৃত্তিকা উপাদানের মতো খনিজগুলোর ক্রমবর্ধমান চাহিদা মুসলিম দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ।

বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, চীন এবং ভারতের মতো বৃহৎ অর্থনীতির জন্য, মধ্যপ্রাচ্যের তেল অপরিহার্য । এই দেশগুলোর জ্বালানি নিরাপত্তা সরাসরি মুসলিম বিশ্বের স্থিতিশীলতা এবং সম্পদ প্রবাহের উপর নির্ভরশীল। ১৯ শতকের শেষের দিকে, যখন ইউরোপীয় শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিল, তখন থেকেই এই সম্পদ-সমৃদ্ধ ভূমি তার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অর্জন করে । অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিনের আবিষ্কারের পর তেলের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা এই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক তেল শিল্পের বিকাশের পথ প্রশস্ত করে ।

মুসলিম বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদের বিশাল মজুদের তথ্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরে যে, এই অঞ্চল বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য কতটা অপরিহার্য। তবে, এই সম্পদের প্রাচুর্য প্রায়শই অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সংঘাতের কারণ হয়েছে, যা "সম্পদের অভিশাপ" (resource curse) নামক একটি ধারণার জন্ম দিয়েছে। এই ধারণাটি নির্দেশ করে যে, যে সম্পদ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে পারত, তা উল্টো অস্থিতিশীলতা ও বহিরাগত হস্তক্ষেপের কারণ হয়েছে। সম্পদের প্রাচুর্য বহিরাগত শক্তিগুলোর উচ্চ আগ্রহ সৃষ্টি করে, যা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়। এই প্রতিযোগিতা প্রায়শই অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও সংঘাতকে উস্কে দেয়, যার ফলে দেশগুলো সম্পদ থাকা সত্ত্বেও অস্থিতিশীল থাকে। এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও ক্ষুণ্ন করে। এটি স্থানীয় সরকারগুলোকে রাজস্বের জন্য সম্পদের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল করে তোলে, যা তাদের জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এটি সামরিকীকরণকে উৎসাহিত করে এবং গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে, কারণ শাসকরা তাদের ক্ষমতা বজায় রাখতে সম্পদ ব্যবহার করে ।

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার প্রধান খনিজ সম্পদ এবং তাদের বৈশ্বিক গুরুত্ব এই অঞ্চলের প্রতি বহিরাগত আগ্রহের মূল কারণকে আরও স্পষ্ট করে। পেট্রোলিয়াম (অপরিশোধিত) বৈশ্বিক জ্বালানি নিরাপত্তার মেরুদণ্ড এবং শিল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অপরিহার্য। এই অঞ্চলের দেশগুলো যেমন সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, লিবিয়া, এবং আলজেরিয়া বিশ্ব রিজার্ভের ৫৫% এবং বিশ্ব উৎপাদনের ৩৭.০% এর বেশি পেট্রোলিয়াম ধারণ করে । প্রাকৃতিক গ্যাস ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক জ্বালানি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে ইউরোপের জন্য। ইরান, কাতার, সৌদি আরব, আলজেরিয়া, এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্ব রিজার্ভের ৩২% এবং বিশ্ব উৎপাদনের ২১.০% প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন করে । ফসফেট কৃষি ও সার শিল্পের জন্য অপরিহার্য এবং খাদ্য নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত; মরক্কো ও পশ্চিম সাহারা বিশ্ব রিজার্ভের ৫০% এর বেশি এবং বিশ্ব উৎপাদনের ১৬.৫% ফসফেট উৎপাদন করে । লিথিয়াম আধুনিক প্রযুক্তির (ইলেকট্রিক গাড়ি, ব্যাটারি) জন্য অত্যাবশ্যক, এবং আফগানিস্তানে বিশাল সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে, যাকে "লিথিয়ামের সৌদি আরব" বলা হয় । আয়রন আকরিক ইস্পাত উৎপাদন ও অবকাঠামো উন্নয়নে মৌলিক কাঁচামাল, এবং মৌরিতানিয়া, আলজেরিয়া, সৌদি আরব, মিশর, ও মরক্কোতে উল্লেখযোগ্য মজুদ রয়েছে । এছাড়াও, স্বর্ণ, তামা, ইউরেনিয়াম, বিরল মৃত্তিকা, ম্যাঙ্গানিজ, বক্সাইট, দস্তা, টিন, কোবাল্ট, টাংস্টেন, ট্যান্টালাইটের মতো ৫০টিরও বেশি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রয়েছে যা শিল্প, প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা খাতের জন্য অপরিহার্য ।

এই তথ্য স্পষ্ট করে যে, মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে কেবল বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাসই নয়, বরং আধুনিক বিশ্বের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিভিন্ন খনিজ সম্পদও রয়েছে। এই সম্পদের অসম বন্টন ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং হস্তক্ষেপের জন্ম দেয়, যা পাঠককে বুঝতে সাহায্য করে যে কেন এই অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে এবং বর্তমানে পরাশক্তিগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, এবং কেন এর স্থিতিশীলতা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ।

২. ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার এবং সম্পদের নিয়ন্ত্রণ: একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর, স্থানীয় জনগণকে স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তবে, ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যের নির্দেশে মার্ক সাইকস এবং ফ্রাঁসোয়া জর্জেস পিকট একটি গোপন চুক্তি (সাইকস-পিকট চুক্তি, ১৯১৬) করেন, যা বর্তমান জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন এবং ইরাকের অংশগুলোকে বিভক্ত করে। এই বিভাজনগুলো তেল ক্ষেত্রগুলোর অবস্থানকে কেন্দ্র করে হয়েছিল, যা এই অঞ্চলে ভবিষ্যৎ সংঘাতের বীজ বপন করে । ১৯২০ সালের সান রেমো সম্মেলনে ব্রিটিশ-ফরাসি তেল চুক্তি (San Remo Agreement) আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিভাজনকে স্বীকৃতি দেয়, যেখানে ইরাক ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে আসে এবং ব্রিটেন মেসোপটেমিয়ার তেলের উপর স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ লাভ করে । এই চুক্তিগুলো "মানবতার সামগ্রিক সম্পদ" নামক একটি বাগ্মিতা ব্যবহার করে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং অর্থদাতাদের স্বার্থকে ন্যায্যতা দেয় ।

১৯২৮ সালের "রেড লাইন চুক্তি" (Red Line Agreement) আমেরিকান, ব্রিটিশ এবং ফরাসি তেল কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ছিল, যা প্রাক্তন অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ নিয়ে গঠিত হয়েছিল। এই চুক্তির "স্ব-প্রত্যাখ্যানমূলক ধারা" (self-denying clause) অংশগ্রহণকারী কোম্পানিগুলোকে চুক্তির আওতাধীন অঞ্চলে অন্য সদস্যদের সমর্থন ছাড়া তেল ক্ষেত্র উন্নয়ন করতে নিষেধ করে, যা তেল বাজারে প্রতিযোগিতা সীমিত করে এবং পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর আধিপত্য নিশ্চিত করে । এই চুক্তিগুলো ব্রিটিশ এবং আমেরিকান-নিয়ন্ত্রিত তেল শিল্পকে এই অঞ্চলের রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা এবং ব্রিটিশ ও আমেরিকান সাম্রাজ্যের ভূমিকাকে আকার দিতে সাহায্য করেছিল ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স ও ব্রিটেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে আসার পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেলের সরবরাহের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ১৯৫০-এর দশকে আমেরিকান অর্থনীতির দ্রুত প্রসারের সাথে সাথে গাড়ির জ্বালানি এবং প্লাস্টিকের জন্য তেলের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পায় । ১৯৫১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের সাথে একটি চুক্তি করে, যা আজও কার্যকর রয়েছে: আমেরিকা অস্ত্র সরবরাহ করবে এবং বিনিময়ে তেল পাবে। এই ব্যবস্থা পারস্পরিক উপকারী হলেও, সৌদি আরবকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূত হিসেবে কাজ করতে এবং অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে । এই ঘটনাকে এক নতুন ধরনের উপনিবেশবাদের জন্ম হিসেবে দেখা হয় ।

ইরানে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা মোহাম্মদ মোসাদ্দেঘ তার দেশের তেল ক্ষেত্র জাতীয়করণ করতে চেয়েছিলেন এবং পশ্চিমা চাপ প্রতিহত করেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায়, সিআইএ এবং এমআই৬ একটি অভ্যুত্থান ঘটায় এবং শাহকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে, যা বৈশ্বিক শক্তিগুলো তাদের তেল স্বার্থ সুরক্ষিত করতে কতটা নির্মমভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে তার প্রমাণ । এই পদক্ষেপ আধুনিক ইরানের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর উত্তেজনার কারণ হিসেবে বিবেচিত হয় ।

মধ্যপ্রাচ্যে তেলের প্রাচুর্য দশক ধরে যুদ্ধ ও সহিংসতা সৃষ্টি করেছে। উপনিবেশ এবং তেলের তৃষ্ণা শত শত হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে । এই ধারণাটি "সম্পদের অভিশাপ" (resource curse) নামে পরিচিত, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও একটি দেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতায় ভোগে ।

ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো কেবল সম্পদ শোষণ করেনি, বরং এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করেছে যা দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতা ও বহিরাগত হস্তক্ষেপের জন্য অনুকূল। সাইকস-পিকট চুক্তি এবং সান রেমো চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক বিভাজনকে তেলের অবস্থানের সাথে সরাসরি যুক্ত করেছে। "রেড লাইন চুক্তি" এই বিভাজনকে পশ্চিমা তেল কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের কাঠামোতে পরিণত করে। এর ফলে, স্থানীয় জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয় এবং সংঘাতের বীজ বপন করা হয় । এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি গভীর মূল কারণ। এটি মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে কৃত্রিম সীমানা তৈরি করে এবং জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজনকে উস্কে দেয়। এর পরিণতিতে দুর্বল ও নির্ভরশীল রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি হয়, যা বহিরাগত হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে। এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে "সম্পদের অভিশাপ" ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে। এটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন এবং জাতীয় পরিচয়ের বিকাশেও বাধা সৃষ্টি করে, যা দেশগুলোকে বহিরাগত শক্তির উপর নির্ভরশীল করে তোলে এবং তাদের নিজস্ব সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষমতাকে সীমিত করে । এটি এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করে, যা তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে বাধা দেয়।

মুসলিম দেশগুলোতে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের বেশ কিছু ঐতিহাসিক উদাহরণ রয়েছে যা এই অভিযোগের একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করে। ১৯১৬ সালের সাইকস-পিকট চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেন ও ফ্রান্স অটোমান সাম্রাজ্যের তেল সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়, যা মধ্যপ্রাচ্যের কৃত্রিম বিভাজন এবং আঞ্চলিক সংঘাতের বীজ বপন করে । ১৯২০ সালের সান রেমো চুক্তি এই বিভাজনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ইরাকের ওপর ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ও তেল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে । ১৯২৮ সালের রেড লাইন চুক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের তেল কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রাক্তন অটোমান সাম্রাজ্যের তেল ক্ষেত্রগুলোতে পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য নিশ্চিত করে । ১৯৫৩ সালে ইরানে মোসাদ্দেঘ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (সিআইএ) ও ব্রিটেন (এমআই৬) গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে শাহকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে, যা ইরানের তেল সম্পদের ওপর পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করে এবং আধুনিক ইরানের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর দীর্ঘমেয়াদী অবিশ্বাস ও উত্তেজনা সৃষ্টি করে । ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোট দ্বারা ইরাকের কুয়েত আক্রমণ প্রতিহত করতে এবং আঞ্চলিক তেল সরবরাহ ও বৈশ্বিক তেল নিরাপত্তা রক্ষা করতে শুরু হয়েছিল । ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে শুরু হয়েছিল, যেখানে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অজুহাত ব্যবহার করা হয়েছিল, কিন্তু এর পেছনে ইরাকের তেল উৎপাদন ও বাজার উন্মুক্তকরণের উদ্দেশ্য ছিল । ২০১১ সালে লিবিয়ায় পশ্চিমা হস্তক্ষেপ মানবিক হস্তক্ষেপের অজুহাত দিয়ে করা হয়েছিল, কিন্তু এর লক্ষ্য ছিল লিবিয়ার তেল সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা এবং পশ্চিমা অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধি করা, যা দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে ।

এই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে দেখায় যে কীভাবে ঔপনিবেশিক যুগের নীতি এবং চুক্তিগুলো বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করে চলেছে, এবং প্রমাণ করে যে বর্তমান সংঘাতগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের অংশ।

৩. ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এবং পরাশক্তিদের ভূমিকা

মুসলিম বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি পরাশক্তিদের আগ্রহ কেবল ঐতিহাসিক নয়, বরং বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও এটি তাদের কৌশলগত স্বার্থের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রত্যেকেই এই অঞ্চলে তাদের নিজস্ব জ্বালানি নিরাপত্তা এবং ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের উপর নির্ভরশীল, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে । তবুও, বৈশ্বিক তেলের প্রবাহ এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখা মার্কিন অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। মার্কিন অস্ত্র নির্মাতারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যাপক লাভবান হয়েছে। ইরানকে প্রতিহত করার জন্য এই অঞ্চলের দেশগুলোতে, যেমন সৌদি আরবে, ২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি প্রতিরক্ষা বিনিয়োগের চুক্তি হয়েছে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক ও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের মতো সংঘাতে হস্তক্ষেপ করে তার রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট হয়েছে । ইসরায়েল-ইরান সংঘাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করার একটি অজুহাত দিয়েছে, যা ইরানের অর্থনীতিকে দুর্বল করে এবং আন্তর্জাতিক তেল বাজারে তার প্রবেশাধিকার সীমিত করে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের "সর্বোচ্চ চাপ" নীতি (maximum pressure policy) ইরানের অস্থিতিশীল কার্যকলাপের জন্য তহবিল সংগ্রহে বাধা দেওয়ার লক্ষ্য রাখে ।

চীন

চীনের জ্বালানি নিরাপত্তা কৌশল দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানি ও কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করার উপর কেন্দ্রীভূত। ঐতিহাসিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে চীন সরবরাহকারীদের বৈচিত্র্য আনতে চেষ্টা করছে । ২০১৯ সালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনের তেল আমদানির ৪৪% ছিল । চীন আরব-ইসরায়েল সংঘাতে জড়িত না থাকায় অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তেল সরবরাহের উপর মনোযোগ দিতে পারে । মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের পর, চীন আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ, বিশেষ করে লিথিয়াম, তামা, আয়রন আকরিক এবং বিরল মৃত্তিকা উপাদান (rare earth elements) শোষণে আগ্রহ বাড়িয়েছে। ২০২৩ সালে চীন আফগানিস্তানে খনিজ অনুসন্ধানের জন্য ৪৫০ মিলিয়ন ডলার এবং লিথিয়াম আমানত অনুসন্ধানের জন্য সম্ভাব্য ১০ বিলিয়ন ডলার চুক্তি করেছে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চীনা উপস্থিতি নিয়ে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ।

রাশিয়া

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কৌশলগত অংশীদারিত্ব মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নতুন রূপ দিয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য ইরানের ড্রোন পায়, আর ইরান মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মোকাবিলায় একটি কৌশলগত মিত্র পায় । রাশিয়া ওপেক+ জোটের একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, যা বৈশ্বিক তেল উৎপাদন কৌশল নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। এই জোট এখন মূল্য স্থিতিশীলতার চেয়ে বাজার অংশীদারিত্ব পুনরুদ্ধারের উপর বেশি মনোযোগ দিচ্ছে ।

ইউরোপ

ইউক্রেন যুদ্ধের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) তার জ্বালানি নীতি পুনর্বিবেচনা করেছে, রাশিয়ান জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে এবং সরবরাহ বৈচিত্র্য আনতে মনোযোগ দিয়েছে। এটি উত্তর আফ্রিকাকে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানি (যেমন নবায়নযোগ্য শক্তি ও হাইড্রোজেন) সহযোগিতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে তুলে ধরেছে । ইইউ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর সাথে পারস্পরিক উপকারী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, যা কেবল সম্পদ আহরণের পরিবর্তে স্থানীয় উন্নয়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং শক্তি অবকাঠামোতে বিনিয়োগের উপর জোর দেয় । তবে, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত ইউরোপের জ্বালানি নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে, তেলের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং এলএনজি (LNG) খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, এবং রাশিয়ার মতো পরাশক্তিগুলোর নিজস্ব জ্বালানি নিরাপত্তা উদ্বেগ রয়েছে। এই উদ্বেগগুলো তাদের মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য অংশে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক হস্তক্ষেপের মূল কারণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের "তেলের বিনিময়ে অস্ত্র" নীতি, চীনের আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদে আগ্রহ, এবং রাশিয়া-ইরান কৌশলগত অংশীদারিত্ব সবই এই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টার অংশ। পরাশক্তিগুলোর জ্বালানি নিরাপত্তা শুধু তাদের নিজস্ব অর্থনীতির জন্য নয়, বরং তাদের বৈশ্বিক ক্ষমতা বজায় রাখার জন্যও অপরিহার্য। এটি মুসলিম বিশ্বের সম্পদকে একটি ভূ-রাজনৈতিক "দাবার ঘুঁটি"তে পরিণত করেছে, যেখানে দেশগুলো প্রায়শই নিজেদের স্বার্থের পরিবর্তে পরাশক্তিদের স্বার্থ পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরাশক্তিদের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মুসলিম বিশ্বের সম্পদের উপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে তোলে, বিশেষ করে তেল, গ্যাস, এবং নতুন খনিজগুলোর ক্ষেত্রে। এই নির্ভরশীলতা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য কৌশলগত প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়, যা সামরিক হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক চাপ (নিষেধাজ্ঞা), এবং জোট গঠনের দিকে পরিচালিত করে। এর ফলস্বরূপ, মুসলিম দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হয় এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। এই প্রতিযোগিতা মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং তাদের নিজস্ব উন্নয়নের পথকে বাধাগ্রস্ত করে। এটি "জাতীয়করণ" এবং "স্বায়ত্তশাসন" এর প্রচেষ্টাকে দমন করে, যেমনটি ইরানের মোসাদ্দেঘের ক্ষেত্রে দেখা গেছে । এটি আরও ইঙ্গিত করে যে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার স্থিতিশীল রাখার নামে পরাশক্তিগুলো প্রায়শই নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে, যা দীর্ঘমেয়াদী আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দেয়।

৪. 'সন্ত্রাসবাদ' আখ্যান: সম্পদ দখলের একটি কৌশল?

আধুনিক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের প্রথম পর্যায় (১৯৬৮-১৯৭৯) ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, ব্যর্থ রাষ্ট্র গঠন এবং ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, যা আরব ও ইসলামিক বিশ্বে মার্কসবাদী ও পশ্চিমা-বিরোধী আন্দোলনকে উৎসাহিত করে । ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আরব জাতীয়তাবাদের ব্যর্থতা প্রগতিশীল এবং চরমপন্থী উভয় ইসলামিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করে। মুসলিম ব্রাদারহুড এর একটি মূল উদাহরণ । ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন (১৯৭৯-১৯৮৯) সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বৃদ্ধি ও প্রসারে ইন্ধন যোগায়, যা "আরব-আফগান" যোদ্ধাদের একটি নতুন ধারা তৈরি করে ।

৯/১১ হামলার পর 'ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের' হুমকি বিশ্ব মঞ্চে আসে । তবে, অনেক বিশ্লেষক যুক্তি দেন যে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' এই অঞ্চলের সম্পদের উপর নতুন করে "সাম্রাজ্যবাদী তেল দখল" এর একটি সুবিধাজনক আবরণ প্রদান করেছে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতিকে "মুক্ত তেলের" (free oil) পরিবর্তে "স্বাধীনতার তেল" (freedom oil) নিশ্চিত করার দিকে স্থানান্তরিত করার চেষ্টা করেছে, যেখানে তেল স্থানীয় জনগণের জন্য "স্বাধীনতা" বয়ে আনবে বলে চিত্রিত করা হয় । তবে, এই দাবির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে, বিশেষ করে যুদ্ধের শিকার এবং সম্ভাব্য স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে ।

২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। অনেক বিরোধী যুক্তি দিয়েছিল যে এটি জাতীয় নিরাপত্তার হুমকির চেয়ে ইরাকি তেল উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করার একটি প্রচেষ্টা ছিল । যদিও মার্কিন কোম্পানিগুলো ইরাকে প্রত্যাশিত "তেল বনাঞ্জা" পায়নি এবং ইরাকি তেল শিল্পের বেসরকারীকরণ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল, তবুও একাডেমিক বিশ্লেষণ ইঙ্গিত করে যে তেলের উপর নির্ভরতা এবং ইরাকের বিশাল পেট্রোলিয়াম মজুদ যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল । সাবেক ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ারম্যান অ্যালেন গ্রিনস্প্যান ২০০৭ সালে বলেছিলেন যে "ইরাক যুদ্ধ মূলত তেল নিয়েই ছিল" । ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধও ইরাকের কুয়েত আক্রমণের পর আঞ্চলিক তেল সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ এবং বৈশ্বিক তেল নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনে শুরু হয়েছিল ।

২০১১ সালের "আরব বসন্ত" এর সময় লিবিয়ায় পশ্চিমা হস্তক্ষেপ এবং সিরিয়ায় অ-হস্তক্ষেপের ভিন্নতা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের গুরুত্ব তুলে ধরে। লিবিয়ায় হস্তক্ষেপকে "মানবতার রক্ষা" (responsibility to protect) এর নামে ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এর পেছনে পশ্চিমা দেশগুলোর (বিশেষ করে ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) অর্থনৈতিক স্বার্থ, আঞ্চলিক প্রভাব এবং দুর্বল ক্বাদ্দাফি শাসনের বিরুদ্ধে দ্রুত সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল । অন্যদিকে, সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ না করার কারণ ছিল দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, জটিল আঞ্চলিক জোট (ইরান, রাশিয়া, চীন), এবং একটি সম্ভাব্য দীর্ঘস্থায়ী ও অস্থিতিশীল গৃহযুদ্ধের ঝুঁকি । রাশিয়া ও চীন লিবিয়ায় ন্যাটোর হস্তক্ষেপকে "ম্যান্ডেটের অপব্যবহার" হিসেবে দেখে সিরিয়া সংক্রান্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলোতে ভেটো দেয় ।

হামাসের ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার পর, এক্স (পূর্বে টুইটার) সহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে মুসলিম-বিরোধী ঘৃণামূলক ভাষার ব্যবহার ৪২২% বৃদ্ধি পায়। মুসলিম সম্প্রদায়কে সহিংস এবং সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত করা হয়, হামাসের কাজগুলোকে সামগ্রিকভাবে মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় । এই ধরনের আখ্যানগুলি 'ইসলামী চরমপন্থা' এবং 'সন্ত্রাসবাদ' এর মধ্যে একটি সরলীকরণমূলক সংযোগ তৈরি করে, যা মুসলিম বিশ্বাসকে সহিংসতার অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে উপস্থাপন করে ।

'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' এবং ইরাক যুদ্ধের পেছনের তেলের উদ্দেশ্য নিয়ে একাডেমিক বিতর্কগুলো ইঙ্গিত করে যে 'সন্ত্রাসবাদ' আখ্যানটি কেবল নিরাপত্তা উদ্বেগ নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ পূরণের একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। লিবিয়া ও সিরিয়ার ভিন্ন হস্তক্ষেপের ঘটনা দেখায় যে 'মানবতার রক্ষা'র মতো মহৎ উদ্দেশ্যগুলো প্রায়শই পরাশক্তিদের কৌশলগত স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়। 'সন্ত্রাসবাদ' আখ্যানটি মুসলিম দেশগুলোতে হস্তক্ষেপ, শাসন পরিবর্তন এবং সম্পদ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায্যতা প্রদান করে। এটি একটি "আখ্যানের যুদ্ধ" (narrative warfare) যা জনমতকে প্রভাবিত করে এবং সামরিক পদক্ষেপের জন্য সমর্থন তৈরি করে। 'সন্ত্রাসবাদের' হুমকিকে অতিরঞ্জিত করা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডকে সামগ্রিকভাবে মুসলিমদের সাথে যুক্ত করা, মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ন্যায্যতা প্রদান করে, যেমন 'সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন' বন্ধ করার নামে। এর ফলে এই দেশগুলোর অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং অভ্যন্তরীণ শাসন দুর্বল হয়, যা বহিরাগত শক্তিগুলোর জন্য সম্পদ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি করে। এই আখ্যান মুসলিম দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিভেদকে আরও বাড়িয়ে তোলে এবং পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টি করে। একই সাথে, এটি মুসলিম-বিরোধী মনোভাব এবং ঘৃণামূলক বক্তব্যকে উৎসাহিত করে, যা বৈশ্বিক সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং সহাবস্থানের পরিবেশকে নষ্ট করে ।

৫. আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সম্পদ শাসন

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ (UNSC) মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত, বিশেষ করে সিরিয়া ও লিবিয়া সংক্রান্ত অসংখ্য প্রস্তাব নিয়ে কাজ করেছে। তবে, এই প্রস্তাবগুলোর অনেকগুলোই রাশিয়া ও চীনের ভেটোর কারণে ব্যর্থ হয়েছে । রাশিয়া ও চীন সিরিয়া সংক্রান্ত প্রস্তাবে ভেটো দেওয়ার সময় যুক্তি দিয়েছে যে পশ্চিমা দেশগুলো লিবিয়ায় জাতিসংঘের ম্যান্ডেটের অপব্যবহার করে শাসন পরিবর্তন ঘটিয়েছে, যা সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি হুমকি । জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়া থেকে অবৈধ তেল রপ্তানি প্রতিরোধের জন্য নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে, যা এই অঞ্চলের সম্পদের উপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের একটি উদাহরণ ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এবং বিশ্বব্যাংক (World Bank) মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর অর্থনৈতিক নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। তারা ঋণ, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনার উপর শর্ত আরোপ করে । আইএমএফ MENA অঞ্চলের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে, যা তেলের উৎপাদন পুনরুদ্ধার এবং আঞ্চলিক সংঘাত হ্রাসের উপর নির্ভরশীল। তারা এই দেশগুলোকে উচ্চ ঋণ এবং কম-প্রবৃদ্ধির ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণের উপর জোর দিয়েছে । বিশ্বব্যাংক ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাথে অংশীদারিত্ব করেছে, যা MENA অঞ্চলে পানি, জ্বালানি এবং খাদ্য সম্পদের উন্নত ব্যবস্থাপনার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, যার মধ্যে ৬ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত অর্থায়ন জড়িত ।

তেল-নির্ভর অর্থনীতিগুলো প্রায়শই "সম্পদের অভিশাপ" এর শিকার হয়, যেখানে তারা রাজস্বের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল থাকে এবং অন্যান্য খাতের উন্নয়ন অবহেলিত হয় । আইএমএফের পরামর্শ সত্ত্বেও, এই দেশগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী বৈচিত্র্যকরণ এবং স্থিতিশীলতা অর্জন একটি বড় চ্যালেঞ্জ । মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো ইরানের তেল ও গ্যাস খাতকে লক্ষ্য করে, যা দেশটির রাজস্ব প্রবাহকে সীমিত করে এবং তার অর্থনীতিকে দুর্বল করে । সিরিয়ার উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, যদিও কিছু নিষেধাজ্ঞা সম্প্রতি শিথিল করা হয়েছে ।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতা এবং আইএমএফ/বিশ্বব্যাংকের নীতিগত প্রভাব দেখায় যে এই সংস্থাগুলো একদিকে যেমন বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য কাজ করে, অন্যদিকে তেমনি পরাশক্তিদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। লিবিয়া ও সিরিয়ার ক্ষেত্রে ভেটোর ব্যাখ্যা স্পষ্ট করে যে, মানবিক উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ প্রায়শই আন্তর্জাতিক পদক্ষেপকে প্রভাবিত করে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একটি নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করার পরিবর্তে, প্রায়শই বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য এবং পরাশক্তিদের কৌশলগত এজেন্ডার প্রতিফলন ঘটায়। তাদের "মানবতার রক্ষা" বা "ভালো শাসন" এর মতো নীতিগুলো প্রায়শই ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। পরাশক্তিদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে, যেমন ভেটো প্রদান, ঋণ শর্তারোপ, বা নির্দিষ্ট কর্মসূচির অর্থায়ন। এর ফলস্বরূপ, মুসলিম দেশগুলোর সম্পদ ব্যবস্থাপনার উপর পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা তাদের স্বায়ত্তশাসন সীমিত করে এবং বহিরাগত নির্ভরতা বৃদ্ধি করে, যা তাদের নিজস্ব উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে। এটি মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং তাদের নিজস্ব সম্পদ শাসন ও উন্নয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। এটি আরও দেখায় যে "ভালো শাসন" বা "মানবতার রক্ষা"র মতো ধারণার আড়ালে প্রায়শই অর্থনৈতিক ও কৌশলগত উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকে, যা এই দেশগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সিরিয়া ও লিবিয়া সংক্রান্ত ভেটো এবং এর ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা এবং পরাশক্তিদের স্বার্থের প্রাধান্যকে আরও স্পষ্ট করে। সিরিয়া সংক্রান্ত প্রস্তাবে, যেমন ৪ অক্টোবর ২০১১ সালের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অস্ত্র সরবরাহ সংক্রান্ত প্রস্তাবে, চীন ও রাশিয়া ভেটো দিয়েছিল। চীন সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতির কথা বলেছিল, আর রাশিয়া দামেস্কের বিরুদ্ধে অভিযোগমূলক সুরের বিরোধিতা করে সামরিক হস্তক্ষেপের অগ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরেছিল । ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২ সালের আরব লীগের পরিকল্পনা সমর্থন সংক্রান্ত প্রস্তাবেও চীন ও রাশিয়া ভেটো দেয়। চীন সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব ও জনগণের সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতি সম্মান জানানোর কথা বলেছিল, আর রাশিয়া প্রস্তাবটিকে "অভারসাম্যপূর্ণ" আখ্যা দিয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হামলা বন্ধের প্রস্তাবের অভাবের কথা উল্লেখ করেছিল । ১৯ জুলাই ২০১২ সালের সামরিক পদক্ষেপের হুমকি সংক্রান্ত প্রস্তাবেও চীন ও রাশিয়া ভেটো দেয়। চীন প্রস্তাবটিকে "পাল্টা-উৎপাদনশীল" আখ্যা দিয়েছিল এবং রাশিয়া সদস্যদের "অগ্রহণযোগ্য বিবৃতি" প্রদান এবং "ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য" পূরণের জন্য সিরিয়ান সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করার অভিযোগ করেছিল । ২২ মে ২০১৪ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে রেফারেল সংক্রান্ত প্রস্তাবেও চীন ও রাশিয়া ভেটো দেয়। চীন রাষ্ট্রের বিচারিক সার্বভৌমত্ব ও পরিপূরকতার নীতির প্রতি সম্মান জানানোর কথা বলেছিল, আর রাশিয়া প্রস্তাবের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল । এই ভেটো প্রদানের ফলে সিরিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত ও মানবিক সংকট অব্যাহত থাকে এবং বহিরাগত হস্তক্ষেপের সুযোগ বৃদ্ধি পায় ।

লিবিয়া সংক্রান্ত প্রস্তাবে, যেমন ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ সালের অবৈধ তেল রপ্তানি প্রতিরোধ সংক্রান্ত প্রস্তাবে এবং ১৩ জুলাই ২০২২ সালের একই ধরনের প্রস্তাবে, কোনো ভেটো ছিল না এবং প্রস্তাবগুলো সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছিল । এই প্রস্তাবগুলো জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রাখতে এবং অবৈধ তেল রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে ।

এই ঘটনাগুলো দেখায় যে কীভাবে জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো, বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদ, পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ভেটো ক্ষমতা কীভাবে মানবিক সংকট থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, তা স্পষ্ট হয়, যা আন্তর্জাতিক আইনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এটি লিবিয়া ও সিরিয়ার ক্ষেত্রে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া (হস্তক্ষেপ বনাম অ-হস্তক্ষেপ) এবং তার পেছনের কারণগুলো (মানবতার চেয়ে কৌশলগত স্বার্থের প্রাধান্য) তুলে ধরে, যা ব্যবহারকারীর অভিযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে সমর্থন করে।

৬. উপসংহার: জটিল বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের পথ

মুসলিম বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য, বিশেষ করে তেল ও গ্যাস, ঐতিহাসিকভাবেই বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামো এবং ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। ঔপনিবেশিক যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত, পশ্চিমা শক্তিগুলো বিভিন্ন চুক্তি, হস্তক্ষেপ এবং অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে এই সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। "সম্পদের অভিশাপ" ধারণাটি এই অঞ্চলের দেশগুলোর অস্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের অভাবের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত, যা বহিরাগত হস্তক্ষেপের জন্য একটি উন্মুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করে।

'সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' এবং মুসলিমদের 'জঙ্গি' হিসেবে চিত্রিত করার প্রবণতা প্রায়শই ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন ইরাক ও লিবিয়ার ক্ষেত্রে দেখা গেছে। এই আখ্যানগুলি শুধু সামরিক হস্তক্ষেপের ন্যায্যতা দেয় না, বরং মুসলিম-বিরোধী মনোভাবকেও উস্কে দেয় এবং বৈশ্বিক সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে। এই ধরনের আখ্যানগুলো প্রায়শই নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা ব্যক্তির কর্মকাণ্ডকে সামগ্রিকভাবে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়ে দেয়, যা ভুল ধারণা এবং ঘৃণা ছড়ায়।

মুসলিম দেশগুলোর জন্য তাদের সম্পদের উপর সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমেও স্থানীয় উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন, যাতে "সম্পদের অভিশাপ" কাটিয়ে ওঠা যায়। আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোতে খনিজ সম্পদের উন্নয়ন যেন স্থানীয় জনগণের উপকার করে এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করে, তা নিশ্চিত করা জরুরি ।

বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা এবং জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত মুসলিম দেশগুলোর সাথে আরও স্বচ্ছ, ন্যায়সঙ্গত এবং পারস্পরিক উপকারী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মতো সংস্থাগুলোতে ভেটো ক্ষমতার দায়িত্বশীল ব্যবহার এবং মানবিক হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে প্রকৃত মানবিক উদ্দেশ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি, যাতে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের আড়ালে সম্পদ শোষণ বা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি না হয়। 'সন্ত্রাসবাদ' আখ্যানের অপব্যবহার রোধ করা এবং মুসলিম সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে ঘৃণামূলক বক্তব্য বন্ধ করা বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। এটি কেবল মুসলিম দেশগুলোর জন্য নয়, বরং একটি স্থিতিশীল ও সহনশীল বৈশ্বিক সমাজ গঠনের জন্যও অত্যাবশ্যক।

📣 পাঠকদের উদ্দেশ্যে
এই লেখাটি শুধু একটি তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ নয়—এটি একটি দায়বদ্ধ চেতনাপ্রসূত প্রয়াস। মুসলিম বিশ্বের খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ যেভাবে আজও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর টার্গেটে পরিণত হয়েছে, তা কেবল কাকতালীয় নয়, বরং একটি পরিকল্পিত ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ।

আমরা যারা মুসলিম, আমাদের উচিত অতীতকে মনে রাখা, বর্তমানকে বুঝে ওঠা এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হওয়া। এই লেখার মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করেছি আপনাকে সেই অন্তর্নিহিত সত্য ও যুক্তিগুলোর সামনে দাঁড় করাতে, যেগুলো হয়তো সচরাচর আলোচনায় আসে না।

🙏 আপনার মতামত, অভিজ্ঞতা বা প্রশ্ন আমাদের জানাতে ভুলবেন না।
আমরা চাই, আপনি আলোচনায় অংশ নিন, নিজের মতামত দিন এবং সচেতনতা ছড়িয়ে দিন।

❓ সচরাচর জিজ্ঞাস্য (FAQ)
🔸 ১. মুসলিম দেশগুলোকে কেন টার্গেট করা হয়?
মূলত খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা, এবং ঐক্যের অভাব মুসলিম দেশগুলোকে সহজ টার্গেটে পরিণত করে।

🔸 ২. “সন্ত্রাসবাদ” শব্দটি কি রাজনৈতিক হাতিয়ার?
হ্যাঁ। অনেক সময় বিশ্ব শক্তিগুলো এই শব্দটি ব্যবহার করে মুসলিম দেশগুলোতে সামরিক হস্তক্ষেপ ও সম্পদ নিয়ন্ত্রণকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে।

🔸 ৩. মুসলিম বিশ্ব কিভাবে প্রতিরোধ গড়তে পারে?
ঐক্য, নিজস্ব প্রযুক্তি বিকাশ, মিডিয়া শক্তি বৃদ্ধি, ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ভূমিকা জোরদার করেই প্রতিরোধ গড়া সম্ভব।

🔸 ৪. এই লেখার উৎস কী?
বিভিন্ন ঐতিহাসিক রেকর্ড, সংবাদ সংস্থা, গবেষণা পত্র ও মধ্যপ্রাচ্য/আফ্রিকার ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ—সবমিলিয়ে এই লেখাটি রচিত হয়েছে তথ্যনির্ভর গবেষণার ভিত্তিতে।

💬 মন্তব্য করুন
আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সংযোজন জানাতে চান, তাহলে নিচের ফর্মটি পূরণ করে মন্তব্য করতে পারেন।

✍️ আপনার মন্তব্য লিখুন:

আপনার নাম ও মতামত দিন। গঠনমূলক আলোচনা আমরা স্বাগত জানাই।







কল্পকথা ৩৬০

"কল্পনা যেখানে জীবনের গল্প বলে…" Kalpakatha 360 কেবল একটি ব্লগ নয়, এটি অনুভবের এক পূর্ণচক্র। জীবনের প্রতিটি দিক—ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, নস্টালজিয়া, সমাজ, আত্মউপলব্ধি—এই ব্লগে গল্প হয়ে ধরা দেয় শব্দের ভাষায়। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি মানুষের ভেতরেই লুকিয়ে আছে একটি কল্পকথা—কারওটা বলা হয়, কারওটা থেকে যায় না বলা। সেই অনুচ্চারিত গল্পগুলোই এখানে খুঁজে পায় কণ্ঠ। এই ব্লগে আপনি পাবেন: ছোটগল্প ও জীবনভিত্তিক উপন্যাস কবিতা ও ছন্দে বাঁধা অনুভূতি সমাজ সচেতন প্রবন্ধ ও বিশ্লেষণ আত্মউপলব্ধি, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা সময়োপযোগী ভাবনা ও লেখকদের মুক্ত মত প্রকাশ আমরা চাই—আপনি হোন আমাদের পাঠক, সহচর, অথবা গল্পকার। কারণ "Kalpakatha 360" শুধু আমাদের কথা বলে না, এটি আমাদের সকলের কল্পনাকে ছুঁয়ে যায়।

🌸 আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করে এবং আগামীতে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরিতে সহায়তা করে।
আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্প পছন্দ করে থাকেন, জানালে ভালো লাগবে।
নিয়মিত পাশে থাকুন — আপনার সহযোগিতা ও ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে চলার শক্তি।

শুভ কামনায়,
✍️ কল্পকথা-৩৬০ ব্লগ টিম
https://kalpakatha360.blogspot.com

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post