“পলাশীর প্রান্তরে আজও বাজে সুর,
এক বিষাদময় ইতিহাস, এক কালো বিধুর।
সিরাজ আর ক্লাইভের সে অধ্যায়—
যেখানে লেখা আছে জাতির নিয়তি,
আর এক নির্মম সত্যের পরিচয়।
প্রথম পাঠ:
যে জাতি নিজের পায়ে দাঁড়াতে ভোলে,
দুর্বলতার শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে সে।
তার পিঠে বারবার বিঁধে ছুরি,
স্বাধীনতা হারায়, হারায় অধিকার।
বিদেশী শকুনেরা ডানা মেলে আসে,
যখন আপন ঘরে বিভেদ ভাসে।
রক্তের দাগে লেখা সে নীরব কান্না,
অসহায় আত্মসমর্পণে হারানো মান্না।
আত্মশক্তির অভাবে, আত্মমর্যাদা ক্ষয়ে,
সে জাতি কেবলই পরাধীনতার ভয়ে।
দ্বিতীয় পাঠ:
আর যে জাতি বুকে পোষে কালসাপ,
বিশ্বাসঘাতকতার বিষাক্ত অভিশাপ।
ঘরের শত্রু যখন হয় পথপ্রদর্শক,
ইতিহাস তার প্রতি কভু ক্ষমাশীল নয়।
মির্জাফরের ছায়া, ক্লাইভের হাসি—
একই সুতোয় বাঁধা সে সর্বনাশই।
অন্ধ লোভের টানে বিকিয়ে যায় দেশ,
অন্ধকার নেমে আসে, হয় না শেষ।
বিশ্বাসঘাতকদের আশ্রয় দিলে পরে,
জাতির সম্মান ধূলিসাৎ হয় অন্দরে।
এ কাহিনি শুধু নয় অতীতের স্মৃতি,
এ এক চিরন্তন সতর্কবাণী, এক নীতি।
যদি না জাগে জাতি, না হয় একাকার,
তবে বারবার হবে সে ছুরির শিকার।
বিশ্বাসঘাতকতা যদি পায় আশ্রয়,
তবে তার পতন নিশ্চিত, নাহি সংশয়।
সিরাজ আর ক্লাইভ, সেতো শুধু নাম,
শিক্ষা রেখে গেছে তারা, চির অবিরাম।”
দুর্নীতি, অন্যায় আর শোষণের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার না হয়ে, মিম আর গুজবে মেতে উঠি। রাজনীতিতে মীরজাফরের উত্তরসূরিরা আজও প্রভাব বিস্তার করে, আর আমরা আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগি। সামাজিক অবিচার, সাংবাদিক নিখোঁজ, সত্যবাদীদের হয়রানি—এসব ঘটনায় আমরা আজও সিরাজের অপমান দেখার মতো নীরব দর্শক।
বাঙালি জাতিকে সত্যিকার স্বাধীনতা পেতে হলে ঐক্য, আত্মমর্যাদা ও সাহসিকতার চর্চা করতে হবে। না হলে ইতিহাস আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেবে—“যে জাতি নিজে দাঁড়ায় না, তার পিঠেই বারবার ছুরি বসে।”
নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যখন বন্দী করে টেনে হিচঁড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন হাজার হাজার মানুষ নির্লিপ্ত, নির্বিকার দাঁড়িয়ে সেই অপমানের দৃশ্য চুপচাপ উপভোগ করেছিল। যারা একসময় তার বিজয় কামনায় মুখে দোয়া করত, তারাই তখন কৌতুকের ভঙ্গিতে তার অপমানে মেতেছিল। ইতিহাসের এই কালো অধ্যায় শুধু একটি পরাজয়ের গল্প নয়, বরং পুরো একটি জাতির মানসিক দৈন্যের নগ্ন প্রকাশ।
রবার্ট ক্লাইভ জানতেন — বড় সৈন্যদল নয়, একটি দুর্বলচিত্ত, আত্মঘাতী এবং স্বার্থপর জাতিকে পরাজিত করতে কেবলমাত্র কৌশল ও মানসিক বিশ্লেষণই যথেষ্ট। তিনি ঠিকই ধরেছিলেন — বাঙালি একটি বিভক্ত জাতি, যেখানে বিশ্বাসঘাতকরা জন্মায় ঘরে ঘরে, এবং জনসাধারণের একাংশ শুধু তামাশা দেখতে অভ্যস্ত।
আজ প্রায় ২৫০ বছর পরেও, এই জাতিগত মানসিকতা কতটা বদলেছে?
একটু চারপাশে তাকালেই দেখা যায়—
জনগণ চরম দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার নয়, বরং ফেসবুকে মিম বানিয়ে আনন্দ নেয়।
শোষণ, অন্যায় আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের বদলে তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে—“কে মার খাচ্ছে, কে জেল যাচ্ছে”।
মীরজাফরদের উত্তরসূরিরা আজও রাজনীতির অন্দরে ক্ষমতার ভাগ বসায়, আর সাধারণ মানুষ খুশি থাকে "চাকরি পাইলে হইল" কিংবা "নিজের পেট বাঁচলে সব ঠিক" মানসিকতায়।
স্বাধীনতা পাওয়ার পরও আমরা মানসিকভাবে সেই দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারিনি।
বড় বড় কথার আড়ালে আজও আমাদের চালায় আত্মস্বার্থ, দলকানা প্রবণতা, আর ভীরু চিন্তাভাবনা।
যে জাতি নিজের নেতার অপমান দেখে হেসে ফেলে, সে জাতি নিজের অধিকার আদায় করবে কীভাবে?
আজ যখন সমাজের সত্যবাদী কাউকে সামাজিকভাবে “বন্দী” করা হয়, তখনো আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। যখন কোনো সাংবাদিক নিখোঁজ হয়, তখনো আমাদের উৎসুক চোখ তামাশা খোঁজে—প্রতিবাদ নয়।
সিরাজউদ্দৌলা আর রবার্ট ক্লাইভের কাহিনি আমাদের শেখায়—
যে জাতি নিজে দাঁড়ায় না, তার পিঠে বারবার ছুরি বসে।
যে জাতি বিশ্বাসঘাতকদের আশ্রয় দেয়, ইতিহাস তার প্রতি ক্ষমাশীল হয় না।
বাঙালি জাতি যতদিন নিজের আত্মমর্যাদা, ঐক্য ও দায়িত্ববোধে জাগ্রত না হবে, ততদিন ইতিহাস আমাদের বারবার হেনস্তা করবে। রবার্ট ক্লাইভের ভবিষ্যদ্বাণী তখনো সত্য ছিল, আজও সত্য—
“এই জাতিকে পরাস্ত করতে যুদ্ধ নয়, শুধু মনস্তত্ত্ব বোঝলেই যথেষ্ট।”
#ইতিহাসেরপাঠ
#সিরাজউদ্দৌলা
#বাংলাদেশেরবাস্তবতা
#মীরজাফরেরউত্তরসূরি
#মনস্তাত্ত্বিকগোলামি