বাংলাদেশে রাজনীতি এখন শুধু রাষ্ট্র পরিচালনার উপাদান নয়, বরং মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। অস্থির অর্থনীতি, চাকরি সংকট, রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং দলান্ধতা রাজনীতিকে একটি জীবনধারায় রূপ দিয়েছে। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে কর্মজীবন পর্যন্ত সবখানে রাজনৈতিক পরিচয় মানুষকে সংজ্ঞায়িত করে। নির্বাচন, মিছিল, ও সামাজিক মাধ্যমে ট্রলিং—এসবই প্রতিদিনের বাস্তবতা। রাজনীতিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বিশাল একটি পেশাভিত্তিক ইকোসিস্টেম যেখানে ট্রল, সাংবাদিক, লাঠিয়াল, ও বিশ্লেষক সক্রিয়ভাবে যুক্ত। এছাড়া সংস্কৃতি, সাহিত্য বা প্রযুক্তিভিত্তিক আলোচনার অভাব মানুষকে রাজনীতি ছাড়া কিছু ভাবতে শেখায়নি। ফলে রাজনীতি হয়ে গেছে তাদের একমাত্র উত্তেজনার খোরাক। এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে প্রয়োজন বিকল্প চিন্তা, শিক্ষা, মূল্যবোধ ও সচেতন নাগরিক সমাজের জাগরণ। না হলে দেশ চলবে শুধু নির্বাচনের নাটক আর ক্ষমতার পালাবদলে, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবন থেকে যাবে অনির্বাচিত ও অবহেলিত। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন যেমন প্রয়োজন, তেমনই এক ভয়ঙ্কর নেশা।
বাংলাদেশে যখনই কোনো চায়ের দোকানে বসা যায়, আলোচনা ঘুরে ফিরে রাজনীতি নিয়ে।
টেলিভিশন খুললেই নানা বর্ণের রাজনীতিবিদদের কথা; সামাজিক মাধ্যমে স্ক্রল করলেই একেকজন “বিশেষজ্ঞ” বিশ্লেষণ করছেন কারা দেশ ধ্বংস করছে, কারা রক্ষা করছে।
প্রশ্ন জাগে—এত নির্বাচন, এত মিছিল-মিটিং, এত বিশ্লেষক কেন?
বাংলাদেশে রাজনীতি আজ কেবল একটি রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা নয়, বরং একটি জীবনধারা।
এই সমাজে রাজনীতি শুধু শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু নয়, মানুষের জীবনের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।
কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে কিছু মূল বিষয় বেরিয়ে আসে—
১. অস্থির অর্থনীতি ও চাকরি সংকট:
যেখানে মেধার মূল্যায়নের সুযোগ সীমিত, সেখানে রাজনীতি হয়ে উঠেছে নিরাপদ ‘শর্টকাট’।
অনেকেই দেখেছেন, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলে ক্ষমতা, প্রভাব, এমনকি চাকরি ও ব্যবসার সুবিধা আসে।
ফলে তরুণ সমাজ পড়াশোনার বদলে ব্যানার বানাতে, স্লোগান দিতে বেশি আগ্রহী।
২. রাজনীতিকে কেন্দ্র করে জীবিকা:
বাংলাদেশে রাজনীতির চারপাশে তৈরি হয়েছে বিশাল একটি "ইকোসিস্টেম" — সাংবাদিক, সোশ্যাল মিডিয়া কর্মী, পেইড ট্রল, লাঠিয়াল বাহিনী, ঠিকাদার, এমনকি অতি উচ্চশ্রেণির পলিসি-বিষয়ক বিশ্লেষকরাও এর অংশ।
তারা সক্রিয় থাকে, কারণ এটা তাদের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩. রাজনৈতিক মেরুকরণ ও দলান্ধতা:
এখানে শিশু বয়স থেকেই মানুষ রাজনৈতিক পরিচয়ে ভাগ হয়ে যায়।
স্কুল-কলেজে ছাত্ররাজনীতি, কর্মজীবনে দলীয় যোগসূত্র — সবমিলিয়ে ব্যক্তি পরিচয়ের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায় "আমি কোন দলের"।
ফলে প্রতিটি বিষয়ের বিচার হয় দলীয় চশমায়।
৪. গণতন্ত্রের নামেই প্রতিযোগিতার নাটক:
বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর কোনো না কোনো নির্বাচন লেগেই থাকে — জাতীয়, স্থানীয়, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ইত্যাদি।
প্রতিটা নির্বাচনকে ঘিরে থাকে উত্তেজনা, সংঘর্ষ, আর প্রচারযুদ্ধ।
এই নির্বাচনের নাটকীয়তা মানুষকে বিনোদন ও উত্তেজনার রসদ দেয়।
৫. সচেতনতার অভাব ও বিকল্প চর্চার দুর্বলতা:
এদেশে সাহিত্য, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি বা প্রযুক্তিভিত্তিক আলোচনার চর্চা তুলনামূলকভাবে কম।
মানুষ রাজনীতি ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবতে বা আলোচনা করতে শেখেনি।
ফলে বিনোদন থেকে রাগ, হতাশা—সবই রাজনীতিতে গিয়ে পড়ে।
রাজনীতি যদি নাগরিকের চেতনায় প্রভাব ফেলে, তা ভালো।
কিন্তু যদি তা তার পেশা, পরিচয় ও জীবনের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, তখনই সমস্যা তৈরি হয়।
বাংলাদেশে রাজনীতি এখন জনগণের ‘জীবনের বিকল্প’, যা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি ‘নেশা’তে পরিণত হয়েছে।
সমাধান একটাই— *সচেতন নাগরিক সমাজ, বিকল্প চিন্তা ও মূল্যবোধের চর্চা।*
না হলে আমরা সবসময়ই শুধু নির্বাচন দেখব, কিন্তু নিজেদের জীবন—নির্বাচিত করতেই পারব না।
#বাংলাদেশেররাজনীতি
#সমাজওসচেতনতা
#প্রবন্ধ
#রাজনীতিরনেশা