স্বপ্ন দেখা সহজ, কিন্তু সেই স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখা কি সম্ভব? এই প্রশ্নটি যেন বাংলাদেশের প্রতিটি ধূলিকণা, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে এক নীরব প্রতিধ্বনি। এক নতুন রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে যে স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, তা কি কেবলই এক ক্ষণিকের ঝলক ছিল, নাকি তা এক অনন্ত সংগ্রামের বীজ?
অন্তর্লীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ও তার অদম্য সংগ্রাম
এক দীর্ঘ, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর যখন নতুন এক সূর্য উঠল, তার আলোয় ঝলমল করছিল এক অদম্য স্বপ্ন—একটি বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ। সেই স্বপ্ন দেখাটা ছিল সহজ, যেন ভোরের শিশিরবিন্দুতে প্রতিফলিত এক নতুন দিনের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু সেই স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখা? সে ছিল এক মহাকাব্যিক যাত্রা, যেখানে প্রতিটি বাঁকে ছিল নতুন পরীক্ষা, নতুন চ্যালেঞ্জ।
এই নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে এগিয়ে এলেন একদল নির্ভীক তরুণ, যাদের নেতৃত্বে ছিল এক দূরদর্শী নারী, আরিফা। তার "জন প্রতিরক্ষা পরিষদ" প্রযুক্তিকে বানিয়েছিল তাদের প্রধান হাতিয়ার। "ডিজিটাল বাংলাদেশ" কেবল একটি স্লোগান ছিল না, তা হয়ে উঠেছিল এক জীবন্ত বাস্তবতা। আরিফা জানতেন, তথ্যই শক্তি, আর স্বচ্ছতাই মুক্তির পথ। তাই তারা চালু করল "People’s Portal" – এক বিপ্লবী প্ল্যাটফর্ম, যেখানে দেশের সাধারণ মানুষ সরাসরি তাদের দাবি-দাওয়া, দুর্নীতি আর অবিচার তুলে ধরতে পারত। গ্রামের কৃষক থেকে শহরের বস্তিবাসী, কারখানার শ্রমিক থেকে শিক্ষক—সবার কণ্ঠস্বর পৌঁছে যেত এক ক্লিকেই, যা আগে ছিল অকল্পনীয়। এই পোর্টাল যেন ছিল স্বপ্নের প্রথম বীজ, যা প্রযুক্তির উর্বর ভূমিতে রোপণ করা হয়েছিল।
কিন্তু প্রতিটি আলোর পেছনে যেমন থাকে এক গভীর ছায়া, তেমনি এই নবগঠিত কাঠামোর বিরুদ্ধে গোপনে সক্রিয় ছিল ‘ছায়া পরিষদ’-এর বাকি ধ্বংসাবশেষ। তারা এই নতুন স্বপ্নকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। তাদের অস্ত্র ছিল অদৃশ্য, কিন্তু ভয়াবহ—সাইবার হুমকি। ‘ছায়া পরিষদ’-এর পুরনো সদস্যরা গোপনে গড়ে তুলল এক ‘ডিজিটাল মিলিশিয়া’—একদল হ্যাকার, যারা ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করত, জনমত নিয়ন্ত্রণ করত। তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা সংকটে পড়ল, সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে উঠল অপব্যবহারের আখড়া। কিশোররা ডুবে গেল ডিজিটাল আসক্তিতে, আর সাইবার অপরাধ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করল। আরিফার সামনে প্রশ্ন—নতুন রাষ্ট্র গঠনের এই যাত্রায় প্রযুক্তি কি তার হাতিয়ার, না বিপর্যয়ের অনুঘটক? স্বপ্ন দেখা সহজ, কিন্তু সেই স্বপ্নকে এই অদৃশ্য শত্রুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা কি সম্ভব?
এই সাইবার যুদ্ধের মধ্যেই রাষ্ট্রের আরেক প্রান্তে চলছিল এক ভিন্ন সংগ্রাম—শ্রমজীবী মানুষের অধিকার রক্ষার যুদ্ধ। গার্মেন্টস খাত, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি, সেখানেই সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত হচ্ছিল দেশের শ্রমিকরা। রুহি, এক গার্মেন্টস শ্রমিক, যার জীবন ছিল এই বঞ্চনার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তার স্বামী এক কারখানার দুর্ঘটনায় আহত, সন্তান স্কুলে পড়লেও খাবারের অনিশ্চয়তা তাদের নিত্যসঙ্গী। কারখানায় দীর্ঘ সময় কাজ, ন্যায্য মজুরি না পাওয়া, অসুস্থ হলেও ছুটি না মেলা—এসব নিয়েই তাদের দিনযাপন। তাদের স্বপ্ন ছিল শুধু দু'বেলা দু'মুঠো ভাত আর সন্তানের মুখে হাসি ফোটানো। এই ছোট স্বপ্নটুকু টিকিয়ে রাখাও যেন ছিল এক অসম্ভব লড়াই।
এই নীরব শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশ ঘটল "শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ"-এর। রুহি, তার অদম্য সাহস আর দৃঢ়তার কারণে হয়ে উঠল এই মঞ্চের এক সাহসী মুখপাত্র। তার কণ্ঠস্বর ছিল লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের অব্যক্ত যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি। যখন একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড কারখানায় শ্রমিক নির্যাতনের প্রমাণসহ তদন্ত শুরু করল, রুহির নেতৃত্বে শুরু হলো এক অহিংস আন্দোলন। মিডিয়ার সহায়তায় তা ভাইরাল হলো, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করল। এই আন্দোলন প্রমাণ করল, স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু প্রযুক্তি নয়, মানুষের ঐক্য আর সাহসও অপরিহার্য। অবশেষে, সরকার ও মালিকপক্ষ বাধ্য হলো—শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করা হলো, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হলো, এবং নিরাপত্তা ও পরিবেশগত মান বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো। একটি রাষ্ট্র তখনই প্রকৃত অর্থে উন্নত হয়, যখন তার শ্রমিক শ্রেণি সুরক্ষিত, মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানিত বোধ করে। রুহির এই বিজয় ছিল স্বপ্নের এক নতুন দিগন্ত, যা প্রমাণ করল, স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব, যদি তার পেছনে থাকে সম্মিলিত সংগ্রাম।
শহর থেকে দূরে, বাংলাদেশের প্রাণ, গ্রাম—সেখানেও চলছিল স্বপ্নের এক ভিন্ন লড়াই। চর গোবিন্দপুর, এক কৃষিপ্রধান গ্রাম, যেখানে মানুষের জীবিকা কৃষিকাজ। কিন্তু সেচের অভাব, রাস্তার বেহাল অবস্থা আর চাষের পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় তারা ধীরে ধীরে ঋণের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছিল। তাদের স্বপ্ন ছিল শুধু ফসলের ভালো ফলন আর পরিবারের মুখে হাসি। এই স্বপ্নও যেন ছিল এক সুতোয় ঝুলে থাকা প্রদীপ।
এই গ্রামেরই মেয়ে মীম, ঢাকায় পড়ালেখা শেষ করে ফিরে আসে গ্রামে। তার চোখে ছিল এক নতুন স্বপ্ন—গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্য একটি ডিজিটাল শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলা। সে চেয়েছিল প্রযুক্তির আলোয় গ্রামের অন্ধকার দূর করতে। তার পাশে এসে দাঁড়ালেন রহমান চাচা, একসময় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন, এখন অবসরপ্রাপ্ত। দুজন মিলে গ্রামের উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি করলেন। কিন্তু বাধা এল প্রশাসন ও রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে। উন্নয়ন প্রকল্প আসে, কিন্তু তা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দুর্নীতিপরায়ণ স্থানীয় নেতারা। জনতার ট্যাক্সে নির্মিত ব্রিজ পড়ে থাকে অসম্পূর্ণ, স্কুল ভবনের বাজেট গায়েব। গ্রামের মানুষের স্বপ্নগুলো যেন বারবার হোঁচট খাচ্ছিল।
কিন্তু মীম হাল ছাড়ল না। তার আহ্বানে গ্রামের তরুণরা সংগঠিত হলো। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরল বাস্তবতা, যা মিডিয়ায় খবর প্রকাশ হলে উচ্চ মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করল। সরকারি তদারকির মাধ্যমে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হলো, গ্রামের মানুষের আস্থা ফিরে এল। কিন্তু মূল প্রশ্ন রয়ে গেল—এই উন্নয়ন কি টেকসই? নাকি আবারও গ্রাম হবে শুধুই নির্বাচনের সময়কার প্রতিশ্রুতির ঝুড়ি? "যে গ্রামের চাষে দেশের পেট ভরে, সে গ্রাম যদি ক্ষুধায় কাঁদে—তবে উন্নয়ন শুধুই এক পক্ষের গল্প। আর গ্রাম? সে আজও গর্জে ওঠে, কিন্তু কাঁদে নীরবে।" গ্রামের এই গল্প যেন বারবার মনে করিয়ে দেয়, স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখা এক নিরন্তর সংগ্রাম।
দেশজুড়ে যখন গণসচেতনতার ঢেউ, তখনই ‘ছায়া পরিষদ’ নামের সেই গোপন সংগঠন চূড়ান্ত ষড়যন্ত্রে নামল। তারা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সব স্তরে অনুপ্রবেশ করে আইন, শিক্ষা, প্রশাসন ও মিডিয়া—সবখানে ছড়িয়ে দিল দুর্নীতি ও ভয়। আরিফা ও তার সহযোদ্ধারা, রায়হান, তামিম, নাজমুলরা, ‘আলোর জাগরণ’ নামক প্ল্যাটফর্ম থেকে দেশের সচেতন তরুণ-তরুণীদের নিয়ে গড়ে তুলল এক বিকল্প নেতৃত্ব। তারা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জনতার সত্যকে সামনে আনল। ভুয়া মামলায় গ্রেফতার, হুমকি, লোভের জালে ফাঁসানো চেষ্টা—কোনো কিছুই তাদের দমাতে পারল না। তরুণরা একত্রে রুখে দাঁড়াল, মানুষের সাড়া পেল, আর তাদের ঐক্য হয়ে উঠল এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি।
এক চূড়ান্ত রাত এসে উপস্থিত হলো, যেখানে নির্ধারিত হলো—বাংলাদেশ দুর্নীতির ছায়ায় ঢেকে যাবে, নাকি গণমানুষের চেতনায় আলোকিত হবে। রাজপথে নামল লাখো মানুষ। গগনবিদারী স্লোগান, চোখে স্বপ্ন, আর হাতে ন্যায়ের পতাকা। আরিফার দলকে থামাতে সরকারের শেষ অপচেষ্টা হিসেবে মিডিয়া ব্ল্যাকআউট করা হলো, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হলো। কিন্তু গোপনে তথ্য ফাঁস হতে থাকল, আন্দোলনের কৌশল ছড়িয়ে পড়ল মানুষের মুখে মুখে। এক ভয়াবহ সংঘর্ষ হলো—যেখানে রক্ত ঝরল, ত্যাগ হলো, কিন্তু দমে না সংগ্রাম।
অবশেষে, ‘ছায়া পরিষদ’-এর নেতারা ধরা পড়ল। আদালতে দাঁড়িয়ে আরিফার জোরালো বক্তব্য—“এটা আমার নয়, আমাদের লড়াই। এক ন্যায়ের বাংলাদেশ গড়ার লড়াই।” তার এই কথাগুলো যেন ছিল প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের প্রতিধ্বনি।
এরপর এক নতুন সূর্য উঠল। রাষ্ট্রপতি পদে আরিফার নির্বাচন ছিল সেই নতুন ভোরের প্রতীক। একটি নতুন বাংলাদেশ, যেখানে সত্য, ন্যায়, মর্যাদা আর মানবিকতা প্রতিষ্ঠিত। "অন্তর্লীন বাংলাদেশ" শেষ হয় নতুন বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি দিয়ে—যেখানে জনগণই হবে সবচেয়ে বড় শক্তি।
স্বপ্ন দেখা সহজ, কিন্তু সেই স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখা কি সম্ভব? বাংলাদেশের এই গল্প প্রমাণ করে, হ্যাঁ, সম্ভব। তবে তা কোনো এককালীন অর্জন নয়, বরং এক নিরন্তর সংগ্রাম। রুহির জীবনসংগ্রাম, মীমের গ্রামের জন্য লড়াই, আর আরিফার নেতৃত্বে ‘ছায়া পরিষদ’-এর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়—এসবই সেই স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি, যা বারবার প্রতিকূলতার মুখেও মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।
"আলোর জন্য যারা জীবন দেয়, তাদের গল্প মুছে যায় না। অন্তর্লীন বাংলাদেশ উঠে আসে তখনই, যখন সাহসীরা থেমে থাকে না।" এই প্রতিটি সংগ্রাম, প্রতিটি ত্যাগ, প্রতিটি বিজয়ই প্রমাণ করে, স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব, যদি সেই স্বপ্ন হয় সম্মিলিত, যদি সেই স্বপ্ন হয় ন্যায়ের, আর যদি সেই স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য থাকে অদম্য সাহস আর অবিরাম প্রচেষ্টা।