কাল্পনিক শিল্প যাত্রা: এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন

"যুবকদের পাশে দাঁড়ালে তারাও পারে গড়তে এক নতুন বাংলাদেশ।" এই বাক্যটি কেবল একটি আশাবাদ নয়, এটি আমাদের সমাজের এক গভীরতম সত্য। একটি জাতির প্রাণভোমরা হলো তার সংস্কৃতি। যেখানে সংস্কৃতি বেঁচে থাকে, সেখানেই জাতির আত্মা জেগে ওঠে, তার নিজস্ব পরিচয় ও অস্তিত্বের জানান দেয়। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে সেই আত্মা যেন এক অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে। চারপাশে এমন অনেক গল্প, যা দেখলে একদিকে যেমন গভীর হতাশা আসে, তেমনি আবার প্রতিরোধের অদম্য স্পর্ধাও জন্ম নেয়। এই লেখাটি কেবল একটি কাহিনী নয়, এটি আমাদের নিজস্ব সংকট, আমাদের ভেতরের সংগ্রাম এবং একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি।

আমরা প্রায়শই শিল্প ও সংস্কৃতির ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করি, কিন্তু এর সত্যিকারের মর্ম অনুধাবন করতে ব্যর্থ হই। সংস্কৃতি কেবল বিনোদন নয়, এটি একটি সমাজের আয়না, তার মূল্যবোধের ধারক ও বাহক। যখন এই আয়না মলিন হয়, যখন তার প্রতিচ্ছবি ঘোলাটে হয়ে ওঠে, তখন জাতির আত্মাও পথ হারায়। আজ আমাদের চারপাশে এমনই এক মলিন চিত্র। জাতীয় নাট্যশালার পরিত্যক্ত মঞ্চে বসে আছেন বৃদ্ধ অভিনেতা ফিরোজ স্যার, যিনি একসময় স্বাধীনতার পরপরই মঞ্চে 'জাগো বাঙালি' নাটক মঞ্চস্থ করে হাজারো দর্শককে কাঁদিয়েছিলেন। সেই মঞ্চে তখন ছিল প্রতিরোধের আগুন, ছিল মুক্তির স্বপ্ন। কিন্তু আজ সেই একই মঞ্চে বসে তিনি স্টেজ ভাড়া দিতে না পারার কষ্টে কাঁদেন। এই অশ্রু কেবল ফিরোজ স্যারের ব্যক্তিগত কষ্ট নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক দৈন্যের এক করুণ প্রতিচ্ছবি। একজন প্রতিভাবান শিল্পীর আত্মমর্যাদা যখন অর্থকষ্টের কাছে হার মানে, তখন সেই সমাজ কতটা অসুস্থ, তা সহজেই অনুমেয়।

শুধু ফিরোজ স্যার নন, এমন অনেক প্রতিভাবান মানুষ আজ হতাশায় নিমজ্জিত। শিল্পী মীম, একসময় যিনি টেলিভিশনের নিয়মিত মুখ ছিলেন, যার অভিনয় দেখতে দর্শক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত, আজ তিনি ইউটিউবে স্বল্পদৈর্ঘ্য নাটক বানিয়ে দিন পার করছেন। তাতেও না আছে পর্যাপ্ত ইনকাম, না আছে সেই পূর্বের সম্মান। তার শিল্পসত্তা যেন এক ডিজিটাল গোলকধাঁধায় আটকা পড়ে গেছে, যেখানে সৃষ্টিশীলতার চেয়ে অ্যালগরিদমের গুরুত্ব বেশি। সংগীতশিল্পী নাবিলার কথাগুলো যেন আমাদের সময়ের কঠিন বাস্তবতা: "গান এখন বিনোদন নয়, অ্যালগরিদমের খোরাক।" এই কথাগুলো কেবল একজন শিল্পীর ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, এটি সমগ্র শিল্পাঙ্গনের এক গভীর ক্ষত। লোকসংগীত, যা আমাদের মাটির গান, আমাদের শিকড়ের সুর, তা আজ দেশের টিভিতে জায়গা পায় না। এই সুরগুলো বেঁচে আছে ইউরোপের উৎসবে, বিদেশের মাটিতে। এটি আমাদের জন্য এক চরম উপহাস। নিজেদের ঐতিহ্যকে আমরা মূল্য দিতে পারিনি, বিদেশের মাটিতে তার কদর হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় অনুদান বিলি হয় পক্ষপাতদুষ্টভাবে, যোগ্য শিল্পীরা বঞ্চিত হন, আর সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো পরিণত হয় রাজনীতির পেটোয়া বাহিনীতে। এই সংকটের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের অবহেলা, অপশাসন এবং একটি সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব। যখন রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার বদলে এটিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তখন জাতির আত্মা দুর্বল হয়ে পড়ে।

কিন্তু এই গভীর সংকটের মধ্যেও কেউ কেউ থেমে যান না। লড়ে যান অদম্য স্পর্ধায়, প্রাণের টানে। এমনই একজন হলেন আরিফা, যিনি অন্ধকার ভেদ করে আলোর মশাল হাতে এগিয়ে আসেন। তিনি গড়ে তোলেন 'কাল্পনিক শিল্প যাত্রা' নামে এক অনন্য সংগঠন। এটি কেবল একটি সংগঠন নয়, এটি এক স্বপ্ন, এক আশ্রয়স্থল— যেখানে তরুণ শিল্পীরা মুক্তভাবে কাজ করার সুযোগ পায়, যেখানে তাদের সৃজনশীলতাকে কোনো রাজনৈতিক বা আর্থিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আরিফার এই উদ্যোগের মাধ্যমে গ্রামীণ সংস্কৃতির সাথে শহুরে প্ল্যাটফর্মের এক দারুণ মেলবন্ধন ঘটে। বাংলার লোকনৃত্য, লোকগীতি, গ্রামীণ গল্প শহুরে আধুনিক মঞ্চে নতুন জীবন পায়। ধীরে ধীরে এই উদ্যোগের মাধ্যমে এক নতুন জাগরণ ফিরে আসে। থেমে থাকা বাঁশি আবার বেজে ওঠে, অন্ধকার মঞ্চে আলোর রেখা ফোটে, আর জাতির ঘুমন্ত আত্মা যেন আবার শ্বাস নিতে শুরু করে। 'কাল্পনিক শিল্প যাত্রা' প্রমাণ করে যে, ছোট একটি উদ্যোগও যদি সততা ও নিষ্ঠার সাথে পরিচালিত হয়, তবে তা এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।

সংস্কৃতি হারালে জাতি পথ হারায়: অন্ধকার থেকে আলোর দিকে

এই অধ্যায়টি এক গভীর বার্তা দেয়: সংস্কৃতি হারালে জাতি পথ হারায়। তাই শিল্পীর কণ্ঠ রোধ নয়, শক্তি দাও। এটি কেবল একটি স্লোগান নয়, এটি একটি জাতির টিকে থাকার মূলমন্ত্র। আলোর নিচেই থাকে সবচেয়ে ঘন ছায়া, আর সেই ছায়ার মধ্য দিয়েই উঠে আসে নতুন সম্ভাবনার সূর্য। যখন আঁধার সবচেয়ে ঘন হয়, তখনই নতুন ভোরের আলো সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়। আরিফা ও তার সাথীদের আন্দোলন 'ছায়া পরিষদ'-এর বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে এক নতুন ধাপে পৌঁছে। 'ছায়া পরিষদ' ছিল সেই অদৃশ্য শক্তি, যা সংস্কৃতির নামে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করত, জাতির আত্মাকে বন্দি করে রাখত। তাদের দমন-পীড়নের কালো মেঘে ঢাকা পড়েছিল পুরো দেশ। কিন্তু সাধারণ মানুষের অন্তরে প্রতিরোধের আলো ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে শুরু করে।

এই প্রতিরোধ কোনো বড় শহর বা রাজধানী থেকে শুরু হয়নি। এটি ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, গ্রাম থেকে গ্রামে। ছোট ছোট সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এমনকি গোপন লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে পরিবর্তনের বার্তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কৃষক তার গানের মাধ্যমে, শ্রমিক তার ছড়ার মাধ্যমে, শিক্ষক তার কথার মাধ্যমে এই পরিবর্তনের বীজ বপন করতে থাকে। প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি পাড়ায় 'কাল্পনিক শিল্প যাত্রা'র অনুসারীরা নিজেদের মতো করে আলোর মশাল জ্বালিয়ে রাখে। এই আন্দোলন কেবল শিল্পীদের আন্দোলন ছিল না, এটি ছিল সাধারণ মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, নিজেদের সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় ফিরে পাওয়ার আন্দোলন।

এই আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিলেন সাংবাদিক রিদয়, যিনি গোপনে 'ছায়া পরিষদ'-এর দুর্নীতির নথি প্রকাশ করেন। তার সাহসী পদক্ষেপ জাতীয় রাজনীতিতে এক ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। দেশের মানুষ জানতে পারে 'ছায়া পরিষদ'-এর ভেতরের জঘন্য দুর্নীতি ও অনাচারের কথা। এই প্রকাশনাগুলো জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করে এবং তাদের প্রতিবাদী করে তোলে। তরুণ প্রজন্ম এইবার বসে থাকেনি। তারা সামাজিক মাধ্যমে গড়ে তোলে 'আলো ফোরাম', যা সত্য, বিচার আর মানবিকতার জন্য কাজ করতে থাকে। এই ফোরামের মাধ্যমে তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, গুজব মোকাবিলা করা হয় এবং মানুষকে একত্রিত করার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়। এটি প্রমাণ করে যে, হতাশার ভেতর থেকেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব, এবং আধুনিক প্রযুক্তিকে সঠিক কাজে লাগালে তা কত শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।

তবে প্রতিটি সাফল্যের পেছনেই থাকে কোনো না কোনো ত্যাগ। এই দীর্ঘ ও কঠিন আন্দোলনে অনেককেই নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক নাবিলা, যিনি তার গানের মাধ্যমে মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার হন। তার গ্রেফতারি ছিল আন্দোলনের জন্য এক বিরাট ধাক্কা, কিন্তু একই সাথে তা মানুষকে আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করে তোলে। শহীদ হন কয়েকজন নিরীহ কর্মী, যারা নিরবে নিভৃতে এই আন্দোলনের অংশ ছিলেন। তাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তাদের স্মরণে আয়োজন করা হয় 'আলোক মিছিল'—সেখানে হাজার হাজার মানুষ হাতে মোমবাতি নিয়ে পথে নেমে আসে, আর তাদের মুখ থেকে একটাই ধ্বনি উচ্চারিত হয়: "আমরা কেউ হারিয়ে যাইনি, আমরা আলো হয়ে আছি।" এই আলোক মিছিল ছিল এক প্রতীকী প্রতিবাদ, যা রাষ্ট্রযন্ত্রকে দ্বিধায় ফেলে দেয়—চেপে রাখবে, নাকি নিজেদের বদলাবে? রাজনৈতিক মহলে ফাটল দেখা দেয়, 'ছায়া পরিষদ' থেকে অনেকেই মুখ ফেরাতে শুরু করে। এই ঘটনাগুলো দেখায়, কীভাবে একটা জাতি নিজেদের নতুন করে চিনতে চায়, কীভাবে তারা অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা শুরু করে।

বিভেদ নয়, সহনশীলতা: একতার পথে বাংলাদেশ

আরিফা যখন রাজনৈতিক সংস্কার আর সমাজ পুনর্গঠনের পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন হঠাৎই এক অদৃশ্য আগুন ছড়িয়ে পড়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে—ধর্মকে কেন্দ্র করে বিভক্তি। এটি ছিল 'ছায়া পরিষদ' ও তাদের অনুসারীদের শেষ চাল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, ঐক্যবদ্ধ জনতাকে দমন করা কঠিন, তাই তারা সমাজে ঘৃণা ও বিভেদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে গুজব, অস্থিরতা, বিভ্রান্তিকর বক্তৃতা। ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়ে কিছু উগ্র গোষ্ঠী সমাজে ঘৃণার বীজ বপন করতে লিপ্ত হয়। যারা একসময় 'ছায়া পরিষদ'-এর ছত্রছায়ায় থেকে বেড়ে উঠেছিল, এখন তারা ধর্মের নামে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে শুরু করে।

একটি শান্তিপূর্ণ গ্রাম, যেখানে হিন্দু-মুসলিম যুগ যুগ ধরে মিলেমিশে বাস করত, সেই গ্রামেই শুরু হয় দাঙ্গা। শুধুমাত্র এক ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে হয়ে ওঠে যে, পুড়ে যায় মন্দির, ভাঙচুর হয় মসজিদ। মানুষ ভুলে যায়, একসময় তারা ছিল প্রতিবেশী, ভাই, বন্ধু। ধর্ম আর মানবতা—এই দুটি শব্দ যেন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে। মানবিকতার ঊর্ধ্বে ধর্মীয় বিভেদকে তুলে ধরা হয়, যা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক। এই সময়টা ছিল আন্দোলনের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময়। যখন সমাজের মূল কাঠামোতেই ফাটল ধরে, তখন কোনো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কঠিন।

কিন্তু এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও আরিফা, রিদয় ও আন্দোলনের সদস্যরা বসে থাকেননি। তারা শুরু করেন 'সহনশীলতা মিছিল'। এটি কেবল একটি মিছিল ছিল না, এটি ছিল শান্তি ও ভালোবাসার এক প্রতিবাদের ভাষা। তারা ধর্মীয় নেতাদের একত্রিত করে গড়ে তোলেন 'একতার মঞ্চ'। এটি ছিল এক অসাধারণ উদ্যোগ, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিরা এক সাথে বসেন, আলোচনা করেন এবং সমাজের শান্তি ফিরিয়ে আনার শপথ নেন। শুরু হয় আন্তঃধর্মীয় সংলাপ, যেখানে একজন ইমাম, একজন পুরোহিত ও একজন খ্রিস্টান যাজক একসাথে দাঁড়িয়ে বলেন, "আমরা আলাদা পথে হাঁটি, কিন্তু পৌঁছাতে চাই এক আলোর উৎসে।" তাদের এই বার্তা ছিল খুবই শক্তিশালী এবং তা সমাজে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই সংলাপের মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পারে যে, ধর্ম কোনো বিভেদের উৎস নয়, বরং তা মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়। এই অধ্যায়টি দেখায়, কীভাবে ধর্মের অপব্যাখ্যা সমাজে অশান্তি ডেকে আনে, আবার কীভাবে সত্যিকারের ধর্মীয় মূল্যবোধ মানুষকে একসূত্রে গেঁথে রাখতে পারে। এটি প্রমাণ করে যে, সংহতি ও সহনশীলতার মাধ্যমেই বিভেদ দূর করা সম্ভব, এবং ধর্মকে শান্তির বাহক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

অন্তর্লীন বাংলাদেশ: নতুন রাষ্ট্রের নৈতিক রূপরেখা

সারা দেশে সহিংসতা, হতাশা, বিশ্বাসঘাতকতা, ও বিদ্রোহের ঝড় পেরিয়ে এবার সময় এসেছে নতুন স্বপ্ন গড়ার। "অন্তর্লীন বাংলাদেশ"-এর এই চূড়ান্ত অধ্যায়ে আরিফা ও তার দল 'নতুন রাষ্ট্রের' একটি নৈতিক রূপরেখা তৈরির উদ্যোগ নেয়। তারা বুঝতে পারে যে, কেবল পুরাতন ব্যবস্থা ভেঙে ফেলাই যথেষ্ট নয়, একটি নতুন, সুন্দর ও নৈতিক সমাজ গড়ে তোলাও অপরিহার্য।

এই লক্ষ্য নিয়ে রাজধানীতে আয়োজন করা হয় "জনগণের সংলাপ"—এক বিশাল মুক্ত আলোচনা সভা। এই সংলাপের বিশেষত্ব ছিল এর ব্যাপক অংশগ্রহণ। কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, ডাক্তার, প্রযুক্তিবিদ থেকে শুরু করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরাও এই সংলাপে অংশ নেয়। প্রত্যন্ত গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক থেকে শুরু করে একজন উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবী—সবাই তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, সমস্যা, প্রশ্ন ও চাওয়াগুলো তুলে ধরে। এটি ছিল একটি সত্যিকারের গণতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া, যেখানে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সাধারণ মানুষ নিজেদের মতামত প্রকাশ করে। তাদের প্রশ্ন, অভিজ্ঞতা ও চাওয়া থেকে তৈরি হয় "নৈতিক নীতি প্রস্তাবনা", যা একটি নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারে। এই প্রস্তাবনা কোনো রাজনৈতিক দল বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর তৈরি করা ছিল না, এটি ছিল জনগণের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর।

এই প্রস্তাবনায় কিছু মৌলিক বিষয় উঠে আসে, যা একটি সুস্থ, উন্নত ও মানবিক সমাজের জন্য অপরিহার্য:

শিক্ষার সর্বজনীনতা ও মানবিকতা: 
প্রস্তাবনায় সবার জন্য সমান ও মানবিক শিক্ষাব্যবস্থার নিশ্চিতকরণের কথা বলা হয়। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হবে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা এবং প্রতিটি শিশুকে তাদের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে সাহায্য করা। শিক্ষা কেবল তথ্য মুখস্থ করা নয়, এটি হবে সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং সহানুভূতি জাগিয়ে তোলার মাধ্যম।

দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন: 
একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির কথা বলা হয়, যেখানে দুর্নীতিকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। প্রশাসন হবে জনগণের সেবক, কোনো শাসক নয়। আইন সবার জন্য সমান হবে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করা হবে।

ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহনশীলতা: 
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য সমান অধিকার ও সহাবস্থান নিশ্চিত করা হবে। রাষ্ট্র কোনো নির্দিষ্ট ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করবে না, বরং সকল ধর্মের প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শন করবে। এটি হবে এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে ভিন্ন মত ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও নিরাপদে ও সম্মানের সাথে বাস করতে পারবে।

প্রযুক্তিনির্ভর পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন: 
পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে প্রযুক্তির মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে পরিবেশ দূষণ কমানো যায় এবং কীভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করা যায়, তা নিয়ে প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়। এটি এমন এক উন্নয়ন মডেল যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পরিবেশের ক্ষতির কারণ হবে না, বরং পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।

নারীর অধিকার ও যৌক্তিক প্রতিনিধি কাঠামো: 
সমাজে নারীর সমান অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হবে। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করা হবে এবং তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

এই নীতি প্রস্তাবনাগুলো কেবল কাগজের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি জাতির সম্মিলিত স্বপ্ন, নতুন করে নিজেদের গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা। এটি দেখায়, কীভাবে একটি বিপর্যস্ত জাতি নিজেদের নতুন করে চিনতে চায় এবং একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। আরিফা ও তার সাথীদের এই যাত্রা প্রমাণ করে যে, যেকোনো অন্ধকার ভেদ করে আলো আসবেই, যদি আমরা একসঙ্গে দাঁড়াই, একসঙ্গে লড়ি। তাদের এই গল্প কেবল একটি কাল্পনিক কাহিনী নয়, এটি আমাদের সকলের জন্য এক অনুপ্রেরণা, এক পথনির্দেশিকা—যেখানে সংস্কৃতি, সহনশীলতা আর মানবিকতার জয় হয়।
Previous Post Next Post
Love Poems
Health Tips
Food & Recipes
Read Books
Job Circulars
Loading...
Loading...
Loading...
Loading...
Loading...