পোড়ামাটির উপাখ্যান: এক নতুন আমার জন্ম

শেষ বিকেলের আলো যখন আমাদের ভাঙা দাওয়ায় এসে পড়ত, তুমি আমার হাত ধরে বলতে, "এই শহরের ধুলোবালি ছেড়ে একদিন অনেক দূরে চলে যাব, নীলু। যেখানে আকাশটা আরও নীল, আর মাটি আরও সবুজ।" তোমার চোখে স্বপ্ন ভাসত, আর আমি সেই স্বপ্নের মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজতাম।


সেই তুমি শহরে হারিয়ে গেলে। বলেছিলে, বড় হবে, অনেক টাকা কামাবে, আমাদের জন্য একটা পাকা বাড়ি বানাবে। আমি আটকাতে চাইনি, কারণ তোমার স্বপ্নগুলো যে আমারও ছিল। শুধু যাওয়ার আগে কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিলে, "অপেক্ষা করিস, আমি ফিরব।"

আমার অপেক্ষা শুরু হলো। প্রথম প্রথম প্রত্যেকটা দিন ছিল এক একটা শতাব্দীর মতো। বুকের ভেতরটা ফাঁকা লাগত, একটা দমচাপা কষ্ট। উঠোনের শিউলি গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, তোমার প্রিয় ফুল। ফুল ঝরে যেত, আবার নতুন কুঁড়ি আসত, কিন্তু তোমার আসার খবর আসত না। গ্রামের মেঠো পথটা যেন আমার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসত।

কষ্ট যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল, সেদিনই আমি প্রথম মাটি ছুঁয়েছিলাম। বাবার কাছে শেখা সেই পুরোনো জলে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধে মনে হলো, এই মাটিরও তো একটা প্রাণ আছে, একটা গল্প আছে। আমার ভেতরের সব না বলা কথা, সব জমে থাকা আবেগ আর দীর্ঘ অপেক্ষা—সবকিছু আমি ঢেলে দিতে লাগলাম মাটির তালে।

আমার হাত ঘুরত, আর চাকের উপর মাটির তাল ধীরে ধীরে রূপ নিত। কখনও কলসি, কখনও প্রদীপ, কখনও বা ছোট ছোট পাখি। প্রতিটি জিনিস বানানোর সময় মনে হতো, আমি যেন নিজেকেই নতুন করে গড়ছি। আমার ভেতরের ভাঙাচোরা অংশগুলো জোড়া লাগছে। এই মাটির কাজই হয়ে উঠল আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন, আমার প্রতিবাদের ভাষা।

এরপর আসত সবচেয়ে কঠিন পর্যায়—পাত্রগুলোকে আগুনে পোড়ানো। চুল্লির গনগনে আগুনের দিকে তাকিয়ে আমার ভয় করত। মনে হতো, এ তো শুধু মাটির পাত্র নয়, আমার সত্তা, আমার স্বপ্ন, আমার অপেক্ষাও এর সাথে পুড়ছে। আগুনের হলকায় কাঁচা মাটির গন্ধ মিলিয়ে যেত, আর জন্ম নিত এক নতুন, পোক্ত রূপ—পোড়ামাটি।

ঠিক আমার মতো। তোমার বিরহের আগুনে পুড়তে পুড়তেই তো আমি নতুন করে জন্মেছি। যে নীলু একদিন শুধু তোমার ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকত, সে আজ নিজের পরিচয় পেয়েছে। আমার বানানো পোড়ামাটির জিনিস এখন গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে শহরেও বিকোয়। সবাই আমার কাজের প্রশংসা করে, কিন্তু তারা জানে না, এর প্রতিটা কণায় আমার কতটা আবেগ, কতটা অপেক্ষা আর কতটা ভালোবাসা মেশানো আছে।

আজও আমি অপেক্ষা করি। তবে সেই অপেক্ষায় এখন আর কোনো অভিযোগ নেই, আছে এক শান্ত সমর্পণ। তুমি ফিরবে কি ফিরবে না, তা আমি জানি না। কিন্তু তোমার জন্য অপেক্ষা করতে গিয়েই আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। আমি শিখেছি, ভালোবাসা মানে শুধু একসাথে থাকা নয়, কারও অনুপস্থিতিতেও তার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রেখে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করা।

এই পোড়ামাটির পাত্রগুলোই আমার উপাখ্যান। আমার ভাঙা-গড়ার গল্প। তোমার অপেক্ষায় জন্ম নেওয়া এক নতুন আমার গল্প।


✍️ লেখিকা : কল্পকথা ব্লগের একজন শুভানুধ্যায়ী। 


📚 কল্পকথা ব্লগ লেখার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ

প্রিয় পাঠক,
আপনারা যারা আমার লেখা পড়ছেন, উৎসাহ দিচ্ছেন—আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই হৃদয়ের গভীর থেকে।
এই গল্পগুলো শুধু কল্পনার নয়, জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। আপনাদের ভালোবাসা আর সঙ্গ ছাড়া এগুলো কখনো আলো দেখতে পারত না।

আমি চেষ্টা করি, প্রতিটি গল্পে ছুঁয়ে যেতে আপনাদের অনুভব।
আপনাদের মন্তব্য, প্রতিক্রিয়া আর ভালোবাসা আমার লেখার শক্তি।

🔹 লেখিকা অনুমতি চায় —
আপনাদের অনুমতি নিয়ে, আমি আরও কিছু নতুন গল্প শেয়ার করতে চাই,
যা হয়তো একদিন আপনাদের জীবনের কোনও অনুভূতির পাশে বসবে।

ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতায়,
— গল্প পাঠক 💙




পোড়ামাটির গল্প: ভালোবাসা, অপেক্ষা ও আত্মঅন্বেষণ
Previous Post Next Post
Love Poems
Health Tips
Food & Recipes
Read Books
Job Circulars
Loading...
Loading...
Loading...
Loading...
Loading...