গল্পের নাম: স্মৃতির কারিগর (প্রথম অধ্যায়)
সময়: ২০৪২ সাল। স্থান: ঢাকা, বাংলাদেশ।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের তাপমাত্রা নিখুঁতভাবে তেইশ ডিগ্রি সেলসিয়াসে স্থির। বায়ু পরিশোধক যন্ত্রের মৃদু গুঞ্জন ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। কক্ষের কেন্দ্রে রাখা আরামদায়ক কিন্তু অত্যাধুনিক একটি চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন লায়লা বেগম। তার কপালে, দুই রগে এবং মাথার পেছনে মসৃণ ধাতব পাত জড়ানো একটি হেডসেট, যার থেকে বেরিয়ে আসা সূক্ষ্ম তারগুলো মিশেছে কক্ষের কোণে রাখা একটি সার্ভারের সঙ্গে। চেয়ারের হাতলে থাকা মনিটরে তার হৃৎস্পন্দন, মস্তিষ্কের তরঙ্গ আর শ্বাস-প্রশ্বাসের হার সবুজ গ্রাফে ওঠা-নামা করছে।
চেয়ারটির পাশে, একটি অর্ধ-স্বচ্ছ হলোগ্রাফিক মনিটরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহনাফ। তার চোখেমুখে কোনো ভাবান্তর নেই, যেন একজন দক্ষ সার্জন অপারেশনের আগে রোগীর রিপোর্ট দেখছেন। মনিটরের ভাসমান পর্দায় লায়লা বেগমের স্মৃতিগুলো বিভিন্ন রঙের সুতোর জটলার মতো দেখা যাচ্ছে। আনন্দের স্মৃতিগুলো সোনালি আভায় উজ্জ্বল, সাধারণ দৈনন্দিন স্মৃতিগুলো শান্ত নীল আর দুঃখ বা বেদনার স্মৃতিগুলো গাঢ় বেগুনি ও কালচে রঙ ধারণ করেছে।
আহনাফের কাজ এই রঙিন জটলার মধ্য থেকে নির্দিষ্ট একটি কালো সুতোকে খুঁজে বের করে নিখুঁতভাবে কেটে ফেলা। সে একজন 'স্মৃতির কারিগর'। তার প্রতিষ্ঠান 'স্মৃতি-টেক-লিমিটেড' সমাজের সেইসব উঁচু তলার মানুষদের সেবা দেয়, যারা নিজেদের অতীতের কোনো কালো অধ্যায়কে চিরতরে মুছে ফেলতে চায়।
"সবকিছু প্রস্তুত, মিসেস লায়লা," আহনাফের শান্ত, প্রায় অনুভূতিহীন কণ্ঠস্বর কক্ষ জুড়ে প্রতিধ্বনিত হলো। "আমরা এখন শুরু করতে পারি। আপনার সম্মতি প্রয়োজন।"
লায়লা বেগম চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ক্ষীণ স্বরে বললেন, "আমি প্রস্তুত। শুধু... এটা কি সত্যিই কাজ করবে? মানুষ কি সব ভুলে যাবে?" তার কণ্ঠে কোটি টাকার সম্পত্তির মালিকানার চেয়েও বেশি ছিল সামাজিক সম্মান হারানোর ভয়। গত সপ্তাহে একটি পার্টিতে নেশার ঘোরে তিনি এমন কিছু কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, যার ভিডিও ফুটেজ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার স্বামী, দেশের একজন প্রভাবশালী শিল্পপতি, টাকার জোরে ভিডিওগুলো নামিয়ে নিয়েছেন, কিন্তু মানুষের স্মৃতি থেকে তো নামাতে পারেননি। সেই দায়িত্ব পড়েছে আহনাফের কাঁধে।
"মানুষের স্মৃতি পরিবর্তনশীল," আহনাফ তার বাঁধাধরা উত্তর দিলো। "ঘটনাটা যারা দেখেছে, তাদের স্মৃতি সময়ের সঙ্গে এমনিতেই দুর্বল হয়ে যাবে। কিন্তু মূল সমস্যা আপনার নিজের স্মৃতি। আপনি ভুলতে পারলেই পৃথিবী আপনার জন্য স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আমরা আপনার মস্তিষ্কের সেই নির্দিষ্ট নিউরাল পাথওয়েটা নিষ্ক্রিয় করে দেবো, যেখানে ওই রাতের স্মৃতি সংরক্ষিত আছে। আপনার কাছে মনে হবে, ওই সন্ধ্যাটা আপনার জীবনে কখনোই আসেনি।"
আহনাফ তার হাতের কনসোলের ওপর কমান্ড দিলো। হলোগ্রাফিক পর্দায় স্মৃতির জটলা জুম ইন হলো। হাজারো সুতোর মধ্যে থেকে সে নির্দিষ্ট তারিখ আর সময় ধরে একটি কুচকুচে কালো সুতোকে চিহ্নিত করলো। সুতোটির গায়ে কাঁটার মতো কিছু তীক্ষ্ণ অংশ, যা আশপাশের সোনালি আর নীল স্মৃতিগুলোকেও যেন বিষাক্ত করে তুলছিল। এটাই সেই রাতের স্মৃতি—অপমান, ভয় আর লজ্জার স্মৃতি।
আহনাফের আঙুলগুলো দ্রুত চলতে লাগলো কনসোলের ওপর। পর্দায় একটি ভার্চুয়াল কাঁচি সেই কালো সুতোটির দিকে এগিয়ে গেলো। এটিই সবচেয়ে দক্ষতার কাজ। সামান্য ভুল হলে আশপাশের কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি, যেমন তার সন্তানের প্রথম হাঁটার স্মৃতি বা বিয়ের দিনের আনন্দের মুহূর্ত, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু আহনাফ তার কাজে সেরা। তার হাত কাঁপে না, মন দ্বিধান্বিত হয় না। সে স্মৃতিকে কেবলই ডেটা হিসেবে দেখে। আবেগ তার কাছে বাইনারি কোডের মতো—শূন্য অথবা এক।
'ক্লিপ'—একটি মৃদু শব্দ হলো। কালো সুতোটি মূল জটলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধীরে ধীরে ছাইয়ের মতো মিলিয়ে গেলো। লায়লা বেগমের মস্তিষ্কের তরঙ্গের গ্রাফে একটি সামান্য পরিবর্তন এলো, তারপর আবার স্থির হয়ে গেলো।
আহনাফ কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো। সবকিছু স্থিতিশীল দেখে সে হেডসেটটি নিষ্ক্রিয় করে দিলো। "প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, মিসেস লায়লা। আপনি এখন উঠতে পারেন।"
লায়লা বেগম ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। তার চোখেমুখে কোনো দ্বিধা বা যন্ত্রণা নেই। কেবল গভীর ঘুম থেকে ওঠার পর যে ধরনের ক্লান্তি থাকে, সেটুকুই অবশিষ্ট। তিনি উঠে বসে চারপাশে তাকালেন।
"শেষ? আমার ঠিক কিছু মনে পড়ছে না... আমি এখানে কেন এসেছিলাম?" তার কণ্ঠে genuine বিস্ময়।
"একটি রুটিন নিউরাল চেকআপের জন্য," আহনাফ শান্তভাবে মিথ্যা বললো। "আপনার স্বামী আপনার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে বেশ সচেতন। সবকিছু ঠিক আছে। আপনার রিপোর্ট আমরা তাকে পাঠিয়ে দেবো।"
লায়লা বেগম সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়লেন। তার সহকারী বাইরে অপেক্ষা করছিল। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তার দামি পার্সটি হাতে নিয়ে কোনোদিকে না তাকিয়েই বেরিয়ে গেলেন। তার চাল-চলনে আগের সেই উদ্বেগ বা লজ্জার ছিটেফোঁটাও নেই। তিনি এখন একজন নির্ভার, সুখী মানুষ।
ক্লায়েন্ট চলে যাওয়ার পর আহনাফ তার ব্যক্তিগত অফিসের দিকে পা বাড়ালো। তার ক্লিনিকটি গুলশানের একটি সুউচ্চ ভবনের পঁয়ত্রিশ তলায় অবস্থিত। কাঁচের দেয়ালের ওপারে ২০৪২ সালের ঢাকার আকাশ। সারি সারি আকাশচুম্বী ভবন মেঘ ফুঁড়ে মাথা তুলেছে। তাদের ফাঁক গলে নিঃশব্দে উড়ে যাচ্ছে ব্যক্তিগত এয়ার-ট্যাক্সি আর বাণিজ্যিক ড্রোন। রাস্তায় কোনো যানজট নেই, কারণ বেশিরভাগ পরিবহনই আকাশপথে। শহরটা অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন, সুশৃঙ্খল এবং প্রযুক্তি-নির্ভর। কিন্তু এই চাকচিক্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভিন্ন জগৎ, যার কারিগর আহনাফের মতো মানুষেরা।
আহনাফ তার চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। এই শহর, এই প্রযুক্তি, সবই মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য তৈরি। কিন্তু আসলেই কি তাই? সে মানুষের দুঃখ মুছে দেয়, কিন্তু সেই দুঃখগুলো কি তাদের পরিচয়ের অংশ নয়? ভুল, লজ্জা, অনুশোচনা—এগুলো ছাড়া কি মানুষ সম্পূর্ণ হতে পারে? এসব দার্শনিক প্রশ্ন তার মাথায় প্রায়ই আসে, কিন্তু সে বেশিক্ষণ ভাবতে চায় না। ভাবলে তার নিজের কাজকে অনৈতিক মনে হতে শুরু করে। আর এই কাজের জন্যই সে আজ এত ঐশ্বর্যের মালিক।
তার ব্যক্তিগত এআই সহকারী 'নূরী'-র কোমল কণ্ঠস্বর তাকে চিন্তার জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনলো। "আহনাফ সাহেব, আপনার জন্য একটি জরুরি বার্তা আছে।"
"পড়ো," আহনাফ চোখ না ফিরিয়েই বললো।
"একজন নতুন ক্লায়েন্ট আপনার সাথে এখনই দেখা করতে চান। তিনি কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেননি, কিন্তু 'সর্বোচ্চ গোপনীয়তা' প্রোটোকলের অধীনে সাক্ষাৎ চেয়েছেন। তিনি এর জন্য যেকোনো মূল্য দিতে রাজি।"
আহনাফের কপাল সামান্য কুঁচকে গেলো। 'সর্বোচ্চ গোপনীয়তা' প্রোটোকল সাধারণ ক্লায়েন্টদের জন্য নয়। এটা কেবল তখনই ব্যবহৃত হয়, যখন ক্লায়েন্টের পরিচয় এতটাই সংবেদনশীল যে, তা কোনো ডিজিটাল রেকর্ডেও রাখা যায় না। সাধারণত শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ বা প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারাই এই সেবা নিয়ে থাকেন।
"পরিচয়?"
"তিনি পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক। পেমেন্ট ক্রিপ্টোকারেন্সিতে হবে, যা ট্রেস করা অসম্ভব," নূরী জানালো।
কৌতূহল আর পেশাদারিত্বের এক অদ্ভুত মিশ্রণে আহনাফ রাজি হয়ে গেলো। "তাকে ভেতরে পাঠাও। আর নিশ্চিত করো, এই সেশনের কোনো ব্যাকআপ রেকর্ড যেন সেন্ট্রাল সার্ভারে না থাকে।"
"নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে," নূরী উত্তর দিলো।
অফিসের স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে গেলো এবং একজন আগন্তুক ভেতরে প্রবেশ করলো। লোকটির পরনে একটি লম্বা, গাঢ় রঙের ওভারকোট, যার হুড দিয়ে মাথা ঢাকা। মুখে একটি অপ্টো-মাস্ক, যা তার চেহারাকে বিকৃত করে রেখেছে। কেবল তার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, যা প্রযুক্তির মাধ্যমে কিছুটা পরিবর্তিত, কিন্তু তার ভেতরের উদ্বেগ স্পষ্ট।
"আপনিই কি আহনাফ... স্মৃতির কারিগর?" আগন্তুকের কণ্ঠে চাপা উত্তেজনা।
"আমিই। বসুন," আহনাফ চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করলো। "আমি আপনার নাম জানতে চাইবো না। শুধু বলুন, কোন স্মৃতিটি মুছতে হবে?"
আগন্তুক বসলো না। সে দাঁড়িয়েই রইলো। ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বললো, "এটা কোনো সাধারণ স্মৃতি নয়। কোনো লজ্জা বা দুঃখের স্মৃতি নয়। এটা আমার কাজের স্মৃতি। গত পরশু, সকাল ন'টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আমি যা যা করেছি, আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোণ থেকে সেই আট ঘণ্টার সম্পূর্ণ স্মৃতি মুছে ফেলতে হবে।"
আহনাফ এবার সত্যি অবাক হলো। তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এমন অনুরোধ সে কখনো পায়নি। মানুষ আবেগ মুছতে আসে, তথ্য নয়। একজন মানুষ তার পেশাগত জীবনের একটি সম্পূর্ণ দিনের স্মৃতি কেন মুছে ফেলতে চাইবে?
"এটা বেশ অস্বাভাবিক অনুরোধ," আহনাফ বললো। "আপনি কি নিশ্চিত যে এটাই চান? এর ফলে আপনার কাজের ধারাবাহিকতায় বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে।"
"আমি সব ভেবেই এসেছি," আগন্তুক প্রায় মরিয়া হয়ে বললো। "আমার জীবনে ওই আট ঘণ্টার অস্তিত্ব আমি রাখতে চাই না। এমনভাবে মুছতে হবে, যেন আমি সেদিন অসুস্থ ছিলাম, বা শহরের বাইরে কোথাও গিয়েছিলাম। একটা ফলস মেমোরি লেয়ার তৈরি করতে পারবেন?"
"পারা সম্ভব, কিন্তু সেটা বেশ জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এর জন্য খরচ অনেক বাড়বে।"
"টাকার চিন্তা করবেন না," আগন্তুক তার কোটের ভেতর থেকে একটি ছোট, চিপের মতো ডিভাইস বের করে টেবিলে রাখলো। "এখানে আপনার পারিশ্রমিকের অগ্রিম হিসেবে দশ গুণ রাখা আছে। কাজ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হলে বাকিটা পেয়ে যাবেন। শুধু কাজটা নিখুঁত হতে হবে। কোনো চিহ্ন থাকা চলবে না।"
আহনাফের মনে বিপদ সংকেত বেজে উঠলো। এই লোক হয় কোনো ভয়ঙ্কর অপরাধ করেছে, নয়তো কোনো ভয়ঙ্কর কিছুর সাক্ষী হয়েছে। এমন কিছু, যা জানার থেকে ভুলে যাওয়াটা তার জন্য বেশি নিরাপদ। আহনাফের উচিত ছিলো তাকে ফিরিয়ে দেওয়া। কিন্তু তার ভেতরের কারিগর সত্তাটি জেগে উঠলো। এমন একটি জটিল কাজ তার জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। আর পারিশ্রমিকের পরিমাণটাও উপেক্ষা করার মতো নয়।
"ঠিক আছে," আহনাফ অবশেষে বললো। "আপনাকে প্রসিডিউর চেয়ারে বসতে হবে।"
আগন্তুক কোনো বাক্যব্যয় না করে চেয়ারে গিয়ে বসলো। আহনাফ তার মাথায় নিউরাল হেডসেটটি পরিয়ে দিলো। মনিটরে লোকটির মস্তিষ্কের মানচিত্র ফুটে উঠলো। আর যা দেখলো, তাতে আহনাফের বিস্ময় চরমে পৌঁছলো।
এই লোকটির স্মৃতির জগৎ লায়লা বেগমের মতো সাধারণ নয়। এর প্রতিটি অংশ অবিশ্বাস্যভাবে সাজানো, যেন কোনো লাইব্রেরির তাক। স্মৃতিগুলো সুতোর মতো নয়, বরং ক্রিস্টালের মতো স্বচ্ছ ব্লকে সাজানো। প্রতিটি ব্লকে ডেটা এনক্রিপ্ট করা। আহনাফ বুঝতে পারলো, এই ব্যক্তি সাধারণ কেউ নয়। সে সম্ভবত একজন বিজ্ঞানী, গবেষক বা ডেটা অ্যানালিস্ট। তার মস্তিষ্কটাই যেন একটা সুপার কম্পিউটার।
আহনাফ নির্দিষ্ট তারিখ ও সময়ের স্মৃতি ব্লকটি খুঁজে বের করলো। ব্লকটি গাঢ় লাল রঙের এবং এর চারপাশে একটি শক্তিশালী ফায়ারওয়াল দেওয়া, যা সাধারণ মস্তিষ্কে থাকার কথা নয়। এই স্মৃতিটি যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
তার পেশাগত নীতি হলো, ক্লায়েন্টের স্মৃতি না দেখেই ডিলিট করা। কিন্তু আজ তার মন মানছিল না। এমন সুরক্ষিত, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি স্মৃতি—এর ভেতরে কী আছে?
প্রক্রিয়া শুরু করার আগে আগন্তুক ফিসফিস করে বললো, "একটা অনুরোধ... প্রক্রিয়া চলাকালীন যদি আমি চিৎকার করি, বা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করি... থামবেন না। কাজটা শেষ করবেন। আমার ভালোর জন্যই এটা জরুরি।"
এই কথাটা আহনাফের বুকের ভেতরটা কাঁপিয়ে দিলো। লোকটি কী এমন দেখেছে বা করেছে, যার জন্য সে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও তা মুছতে চাইছে?
আহনাফ তার কনসোলে কাজ শুরু করলো। সে প্রথমে ফায়ারওয়াল ভাঙার চেষ্টা করলো। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর একটি ছোট পথ তৈরি করতে সক্ষম হলো। নিয়ম অনুযায়ী, তার এখন 'ডিলিট' কমান্ড দেওয়ার কথা। কিন্তু তার আঙুল থেমে গেলো। তার সমস্ত সত্তা জুড়ে তখন তীব্র কৌতূহল। তার দীর্ঘদিনের নীতিশাস্ত্র আর এক মুহূর্তের কৌতূহলের মধ্যে এক নীরব যুদ্ধ শুরু হলো।
শেষ পর্যন্ত, কৌতূহলই জয়ী হলো।
সে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটা নিলো। সে দুটি কমান্ড একসাথে চালালো। একটি কমান্ড আগন্তুকের মস্তিষ্কে ডিলিট প্রক্রিয়া শুরু করলো। একই সাথে, আরেকটি গোপন কমান্ড দিয়ে সে সেই এনক্রিপ্টেড স্মৃতি ব্লকটির একটি কপি তার ব্যক্তিগত, অফলাইন ডেটা-কোরে স্থানান্তর করতে শুরু করলো। এই কাজটি সম্পূর্ণ বেআইনি এবং 'স্মৃতি-টেক'-এর নীতির চরম লঙ্ঘন। ধরা পড়লে তার লাইসেন্স বাতিল তো হবেই, জেলও হতে পারে।
ডেটা স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটি কয়েক মিনিট ধরে চললো। এই সময়টা আহনাফের কাছে অনন্তকালের মতো মনে হচ্ছিলো। তার হৃৎপিণ্ড জোরে জোরে ধকধক করছে। মনিটরে সে দেখছে, লাল ব্লকটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, আর তার ডেটা-কোরে একটি নতুন ফাইল তৈরি হচ্ছে।
অবশেষে, প্রক্রিয়া শেষ হলো। আগন্তুকের মস্তিষ্ক থেকে স্মৃতিটি সম্পূর্ণ মুছে গেছে। তার জায়গায় একটি কৃত্রিম স্মৃতি স্থাপন করা হয়েছে—সেদিন সে ফুসফুসের সংক্রমণে বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছিলো।
আহনাফ হেডসেটটি খুলে দিলো। আগন্তুক ধীরে ধীরে চোখ খুললো। তার চোখেমুখে গভীর ক্লান্তি আর বিভ্রান্তি।
"আমার... আমার মাথাটা এমন ভারি লাগছে কেন?" সে জিজ্ঞেস করলো।
"আপনার সামান্য ইনফেকশন হয়েছিলো। তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া," আহনাফ শান্ত গলায় উত্তর দিলো। "আপনি কয়েকদিন বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।"
আগন্তুক উঠে দাঁড়ালো। তার হাঁটার ভঙ্গি আগের মতো আত্মবিশ্বাসী নয়, কিছুটা টলমল করছে। সে কোনো কথা না বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। দরজার কাছে গিয়ে সে একবার থামলো, ফিরে তাকালো আহনাফের দিকে। তার অপ্টো-মাস্কের আড়ালের চোখ দুটি যেন কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। তারপর কোনো কথা না বলে বেরিয়ে গেলো।
ঘরটা আবার শান্ত, নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। কেবল বায়ু পরিশোধকের সেই মৃদু গুঞ্জন। আহনাফ তার চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে যা করেছে, তা ঠিক না ভুল, সেই বিচার করার মতো মানসিক অবস্থা তার ছিলো না।
তার দৃষ্টি টেবিলের ওপর রাখা ব্যক্তিগত ডেটা-কোরটির ওপর স্থির। ছোট্ট একটি কালো ডিভাইস, কিন্তু তার ভেতরে এখন ধারণ করা আছে এক ভয়ঙ্কর রহস্য। একটি রহস্য, যা জানার জন্য একজন মানুষ নিজের পরিচয়ের একটি অংশকে বিসর্জন দিয়ে গেছে।
আহনাফ কাঁপা কাঁপা হাতে ডেটা-কোরটি তুলে নিলো। এখন প্রশ্ন হলো, সে কি এই রহস্যের দরজা খুলবে? নাকি নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে ডিভাইসটি নষ্ট করে ফেলবে?
বাইরে ২০৪২ সালের ঢাকার ঝলমলে রাত নামছে। কিন্তু আহনাফের মনের ভেতরে তখন কেবলই এক অনিশ্চিত, অন্ধকার ভবিষ্যতের হাতছানি। সে জানে, এই রাতের পর তার জীবন আর কখনো আগের মতো থাকবে না।
(প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত)