গল্পের নাম: স্মৃতির কারিগর (তৃতীয় অধ্যায়)
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ নয়, ওটা যেন মৃত্যুদূতের করাঘাত। প্রতিটি শব্দ আহনাফের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তার বিলাসবহুল, নিরাপদ দুর্গ মুহূর্তের মধ্যে পরিণত হয়েছে এক ফাঁদে। ডক্টর আদনানের আতঙ্কিত মুখটা তার চোখের সামনে ভাসছে—সেই একই পরিণতি কি এখন তার জন্যও অপেক্ষা করছে?
পেশাদার জীবনের সমস্ত ঠাণ্ডা বিচারবুদ্ধি আর আত্মনিয়ন্ত্রণ যেন বাষ্পীভূত হয়ে গেছে। তার ভেতরে এখন কেবল টিকে থাকার এক আদিম প্রবৃত্তি। পালানোর পথ নেই, লুকানোর জায়গা নেই। কিন্তু আত্মসমর্পণ করা মানে নিজের অস্তিত্বকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া। সে জানে ‘স্মৃতি-টেক-লিমিটেড’ এর ‘ভুল শুধরে’ দেওয়ার অর্থ কী। তারা তাকে মুছে ফেলবে। তার জায়গায় স্থাপন করবে নতুন এক আহনাফকে—যে অনুগত, বিশ্বস্ত আর বিপজ্জনক কোনো সত্যের ধার ধারে না।
বাইরের আওয়াজ থেমে গেলো। এরপর এলো এক শীতল, ধাতব কণ্ঠস্বর, যা দরজার স্পিকার দিয়ে ভেসে এলো। "আহনাফ সাহেব। আমরা জানি আপনি ভেতরে আছেন। আপনার হোম-এআই আমাদের নিয়ন্ত্রণে। দয়া করে দরজা খুলুন। আমরা শুধু কয়েকটি বিষয়ে কথা বলতে চাই।"
কণ্ঠস্বরটা মসৃণ, কিন্তু তার আড়ালে লুকিয়ে থাকা হুমকি স্পষ্ট। আহনাফ মরিয়া হয়ে একটা শেষ চেষ্টা করলো। সে তার বিকল হয়ে যাওয়া হোম-এআইকে উদ্দেশ্য করে বললো, "সাথী, ওদের বলো আমি অসুস্থ। আমার পক্ষে এখন কথা বলা সম্ভব না।"
কোনো উত্তর এলো না। পরিবর্তে, দরজার ডিজিটাল লকে একটি লাল আলো জ্বলে উঠে নিভে গেলো। একটি যান্ত্রিক হিস্ শব্দ তুলে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার দরজাটা খুলে গেলো। আহনাফ বুঝতে পারলো, তার দুর্গের চাবি এখন শত্রুর হাতে।
ভারী বুটের শব্দ তার অ্যাপার্টমেন্টের নিস্তব্ধতা ভেঙে এগিয়ে এলো। তিনজন লোক তার স্টাডি রুমে প্রবেশ করলো। তারা সাধারণ গুন্ডা বা ভাড়াটে সৈনিক নয়। তাদের পরনে ‘স্মৃতি-টেক-লিমিটেড’-এর লোগোসহ অত্যাধুনিক কালো কৌশলগত গিয়ার। তাদের নড়াচড়া পেশাদার, ভাবলেশহীন। দলের নেতা, যার নাম ব্যাজে লেখা কামরান, সে বাকিদের থেকে লম্বা এবং তার চোখে এক ধরনের শিকারি পশুর ধূর্ততা।
কামরান ঘরের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে আহনাফের দিকে তাকালো। তার মুখে এক সৌজন্যমূলক কিন্তু শীতল হাসি। "ডক্টর আহনাফ। আপনার সময়টা খারাপ যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আমরা আসলে আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি।"
আহনাফ চুপ করে রইলো। তার মস্তিষ্ক সম্ভাব্য সব উপায় খুঁজছে।
কামরান তার ডেস্কের দিকে এক পা এগিয়ে গেলো। "আমাদের একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রাতিষ্ঠানিক সম্পদ হারিয়ে গেছে। একটি ডেটা প্যাকেট। আমরা জানতে পেরেছি, ওটার শেষ অবস্থান আপনার এই কক্ষে রেকর্ড করা হয়েছে।"
"আমি তোমাদের কথার কিছুই বুঝতে পারছি না," আহনাফ নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললো। "আমি একটা কঠিন সেশনের পর বাড়ি ফিরেছি। আমার বিশ্রাম দরকার।"
কামরানের মুখের হাসিটা আরও চওড়া হলো। সে আহনাফের 'অফলাইন' টার্মিনালটির দিকে আঙুল তাক করলো। "আপনার এই এয়ার-গ্যাপড টার্মিনাল, যা কোনো নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত থাকার কথা নয়, সেটি ঠিক সতেরো মিনিট আগে 'স্মৃতি-টেক-লিমিটেড'-এর একটি এনক্রিপ্টেড ডেটা ব্লকের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছিল। অদ্ভুতভাবে, ওটা সেই একই ডেটা ব্লক, যা ডক্টর আদনানের মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলা হয়েছিলো। কাকতালীয়, তাই না?"
আহনাফের বুকের ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। তার সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্নটাই সত্যি হলো। তার ব্যক্তিগত অভয়ারণ্য, তার সুরক্ষিত সিস্টেম—সবটাই ছিলো একটা বিভ্রম। 'স্মৃতি-টেক-লিমিটেড'-এর জাল সে যা ভেবেছিল, তার চেয়েও অনেক গভীরে বিস্তৃত। তারা শুরু থেকেই সব জানতো।
কামরান তার কোটের পকেট থেকে একটি ছোট ডিভাইস বের করলো। "ডক্টর আদনান একজন বিশ্বাসঘাতক ছিলেন। তিনি কোম্পানির গোপনীয় তথ্য চুরির চেষ্টা করেছিলেন। আপনি সেই তথ্য নিজের কাছে কপি করে একই অপরাধ করেছেন, আহনাফ। তবে, আপনার ভাগ্য এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।" সে ধীরেসুস্থে আহনাফের দিকে এগিয়ে এলো। "ডেটা-কোরটি আমাদের হাতে তুলে দিন। আপনার কৃতকর্মের জন্য আপনাকে ‘পুনঃশিক্ষিত’ করা হবে। আপনি হয়তো আপনার চাকরিটা হারাবেন, কিন্তু জীবনটা ফিরে পাবেন। একটা নতুন, সুখী জীবন। আর যদি তা না করেন..." কামরান তার কথা শেষ করলো না, কিন্তু তার চোখের চাহনি বাকিটা বলে দিলো।
মৃত্যু এর চেয়ে অনেক সহজ পরিণতি হবে।
আহনাফের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। অস্বীকার করা অর্থহীন। লড়াই করা অসম্ভব। সে পরাজিত সৈনিকের মতো হাল ছেড়ে দিলো। তার কাঁধ দুটো ঝুলে পড়লো। সে ধীরে ধীরে ডেস্কের দিকে হাত বাড়ালো, যেখানে ডেটা-কোরটি রাখা আছে।
কামরানের চোখে বিজয়ীর হাসি। দুজন নিরাপত্তা রক্ষীও সামান্য রিলাক্সড হলো। শিকার অবশেষে জালে আটকা পড়েছে।
কিন্তু আহনাফের চোখে তখন পরাজয়ের গ্লানি নয়, ছিলো এক অদ্ভুত স্থিরতা। সে এমন একটি দিনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রেখেছিলো, যা কোনোদিন আসবে না বলেই সে ভাবতো। একজন কারিগর হিসেবে সে কেবল অন্যের স্মৃতি নিয়ে কাজ করেনি, নিজের নিরাপত্তার জন্যও একটি গোপন ব্যবস্থা রেখেছিলো।
ডেস্কের দিকে হাত বাড়ানো অবস্থাতেই, সে শান্ত কিন্তু স্পষ্ট স্বরে একটি পুরনো কবিতার লাইন উচ্চারণ করলো, "স্মৃতির বন্দরে বাঁধা রবে তরী।"
লাইনটি শোনার সাথে সাথে কামরানের কপালে ভাঁজ পড়লো। এটা কোনো সাধারণ কবিতার লাইন ছিলো না। এটা ছিলো একটি ভয়েস-অ্যাক্টিভেটেড কমান্ড। আহনাফের তৈরি করা চূড়ান্ত একটি রক্ষাকবচ।
মুহূর্তের মধ্যে, ঘর কাঁপিয়ে একটি তীব্র কিন্তু শব্দহীন শক্তি বিচ্ছুরিত হলো। একটি শক্তিশালী ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক পালস (EMP)। ঘরের সমস্ত আলো দপ করে নিভে গেলো। টার্মিনাল, মনিটর, কামরানের হাতের ডিভাইস—সবকিছু থেকে মৃদু স্ফুলিঙ্গ বেরিয়ে চিরতরে শান্ত হয়ে গেলো। নিরাপত্তা রক্ষীদের হেলমেটে লাগানো কমিউনিকেশন সিস্টেম ও ভিজ্যুয়াল সেন্সর বিকল হয়ে গেলো। প্রযুক্তি-নির্ভর শিকারিরা মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকারে অন্ধ হয়ে গেলো।
কামরানের মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠলো তীব্র বিস্ময় আর ক্রোধ।
একই সাথে, স্টাডি রুমের বইয়ের শেলফের আড়ালের একটি দেয়াল নিঃশব্দে একপাশে সরে গেলো। সামনে পড়লো একটি অন্ধকার, সরু সুড়ঙ্গ। এটি ভবনের একটি পরিত্যক্ত রক্ষণাবেক্ষণ খাদ, যা আহনাফ বহু বছর আগে আবিষ্কার করে নিজের গোপন পালানোর পথ হিসেবে তৈরি করে রেখেছিলো।
এই আকস্মিক অন্ধকার আর বিভ্রান্তির সুযোগে আহনাফ ডেস্ক থেকে ডেটা-কোরটি ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে এক লাফে সেই সুড়ঙ্গের ভেতরে ঝাঁপ দিলো।
"ওকে ধরো!" কামরানের চিৎকার অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হলো। রক্ষীরা তাদের ম্যানুয়াল ফ্ল্যাশলাইট জ্বালানোর চেষ্টা করতে করতেই কয়েক সেকেন্ড মূল্যবান সময় নষ্ট করে ফেললো।
সুড়ঙ্গের ভেতরটা ভ্যাপসা, অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে। আহনাফের শরীর দেয়ালের পাইপ আর তারের জালের সাথে ঘষা খাচ্ছে। তার দামী পোশাক ছিঁড়ে যাচ্ছে। এই জগৎটা তার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, পরিচ্ছন্ন জীবনের সম্পূর্ণ বিপরীত। সে আক্ষরিক অর্থেই তার কাঁচের প্রাসাদ থেকে ভবনের নোংরা নাড়িভুঁড়ির মধ্যে নেমে এসেছে। পেছনে সে রক্ষীদের পায়ের শব্দ আর কামরানের ক্রুদ্ধ চিৎকার শুনতে পাচ্ছে। তারা খুব বেশি দূরে নেই।
এটা কোনো সিনেমার মতো দ্রুতগতির ধাওয়া নয়। এটা এক রুদ্ধশ্বাস, ক্লস্ট্রোফোবিক তাড়া-খেয়ে পালানো। প্রতি মুহূর্তে ধরা পড়ার ভয়।
সুড়ঙ্গ বেয়ে সে দ্রুত নিচের দিকে নামতে লাগলো। অবশেষে একটি ধাতব হ্যাচ ঠেলে সে বাইরে বেরিয়ে এলো। সে এখন ভবনের সাব-লেভেলে, যেখানে আবর্জনা প্রক্রিয়াকরণ আর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলে। এখানকার বাতাস ভারী, মেশিনের একটানা গুঞ্জন আর পচা আবর্জনার দুর্গন্ধে ভরা। কয়েকজন রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী তাদের ময়লা-ধরা পোশাকে তাকে অবাক হয়ে দেখলো। তাদের চোখে তার দামী পোশাক পরা চেহারাটা বড়ই বেমানান।
মুহূর্তের মধ্যে আহনাফ নিজেকে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলো। সে তার ছেঁড়া কোটটা খুলে ফেলে দিলো। মুখ আর হাতে কালি-ঝুলি মেখে নিলো। সে এখন আর গুলশানের বনানীর স্মৃতির কারিগর নয়। সে এখন একজন পলাতক।
কামরান আর তার দল উপরে তাকে খুঁজছে। সে জানে, মূল ফটক দিয়ে বের হওয়া যাবে না। সে আবর্জনা ফেলার একটি বড় কনভেয়র বেল্টের দিকে দৌড় দিলো। দুর্গন্ধ উপেক্ষা করে সে কনভেয়রের ওপর উঠে পড়লো, যা তাকে ভবনের বাইরের একটি বড় ডাস্টবিনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত পর, সে ভেজা, নরম আবর্জনার স্তূপের ওপর গিয়ে পড়লো।
সে এখন মুক্ত। বনানীর এক পেছনের অন্ধকার গলিতে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার কিছুই নেই। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রিজ হয়ে যাবে। বন্ধু বা পরিচিত বলে কেউ নেই যাকে বিশ্বাস করা যায়। এই শহরে স্মৃতি যখন কেনাবেচার পণ্য, তখন বিশ্বাস সবচেয়ে দুর্লভ।
তার একমাত্র সম্পদ পকেটে থাকা ওই ছোট্ট ডেটা-কোর। এটাই তার বাঁচার একমাত্র আশা, আবার এই কারণেই সে মৃত্যুর মুখে।
আহনাফ শেষবারের মতো সেই বিশাল, ঝলমলে ভবনটির দিকে তাকালো। যা কিছুক্ষণ আগেও তার ঘর ছিলো। এখন সে সেই ব্যবস্থার শিকার, যা সে নিজেই তৈরি করতে সাহায্য করেছে।
চারপাশের গলির অন্ধকারে নিজেকে মিশিয়ে দিলো সে। এখন তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? যার নিজের কোনো পরিচয় আর নিরাপদ নয়, সে কোথায় যাবে?
(তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত)